নদীর দেশ, জল-জঙ্গলের কোল ঘেঁষা এক সবুজ ভূখণ্ড তারই নাম বাংলা। আর এই বাংলার হৃদয়জুড়ে যে দুটি শব্দ যুগ যুগ ধরে স্পন্দিত হয়েছে, তা হলো মাছ ও ভাত। “মাছে ভাতে বাঙালি” শুধু একটি প্রবাদ নয়; এটি এক কালের স্বাদ, মাটির গন্ধ, মায়ের হাতের রান্না, আর চিরন্তন বাঙালিয়ানার প্রতিচ্ছবি। বাংলা ভাষায় বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ- “মাছে ভাতে বাঙালি”। এই প্রবাদটি যেন বাঙালির দৈনন্দিন জীবনযাপন, খাদ্যাভ্যাস এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের এক সহজ অথচ গভীর প্রতিচ্ছবি। বাঙালির কাছে মাছ ও ভাত শুধু খাদ্য নয়, বরং তা এক আবেগ, এক ঐতিহ্য, এক জীবনের দর্শন। একসময় ছিল নদী, খাল, বিল, পুকুরে পরিপূর্ণ।
সেখানে মাছের প্রাচুর্য ছিল স্বাভাবিক বিষয়। ফলে ঐতিহ্যগতভাবেই মাছ হয়ে উঠেছে বাংলার মানুষের প্রিয় খাদ্য। অন্যদিকে ধানচাষ প্রধান অর্থনীতি হওয়ায় ভাত বাঙালির প্রধান আহার। এই দুইয়ের সমন্বয়েই গড়ে উঠেছে এক অনন্য খাদ্যসংস্কৃতি, যা অন্য কোনো অঞ্চলের মানুষের মধ্যে এতটা গভীরভাবে দেখা যায় না।
এই মাটি ভিজে থাকে শ্রাবণের জলে, আর নদীর বুকে খেলে বেড়ায় রূপালি ইলিশ। ঢেঁকিতে ভাঙা চালের গন্ধে মিশে যায় মেঘলা আকাশের আহ্বান। গৃহিণীর কড়াইতে যখন সরষে ফোঁড়ন পড়ে, তখন মনে হয় এ এক অলৌকিক সঙ্গীত। শিশুর প্রথম দুধভাত থেকে বৃদ্ধের শেষ আহার- সবকিছুতেই থাকে ভাত আর মাছের ছোঁয়া।
বাংলার পদ্মা, মেঘনা, যমুনা এই নদীগুলি শুধু জল নয়, প্রাণ। তারা বয়ে আনে মাছের ভাণ্ডার, বাঙালির জীবনের চিরন্তন উপহার। কখনও তা ইলিশের রাজারি, কখনও রুই-কাতলার রাজনীতি। কখনও ঝোলে ডোবা পুঁটি, কখনও ভাজা চিংড়ির সুবাস। ইলিশ, রুই, কাতলা, পুঁটি, শোল, পাবদা, ট্যাংরা, এমন কত রকমের মাছ যে বাঙালির রসনাকে মোহিত করেছে! ইলিশের সরষে বাটা, রুই মাছের কষা, ট্যাংরার ঝোল, পাবদা মাছের দই-পোস্ত বা চচ্চড়ি, এসব শুধু পদের নাম নয়, প্রতিটিই একটি করে আবেগ, একেকটি পরিবারের স্মৃতি, ভালোবাসার মুহূর্ত। প্রতিটি রন্ধনে মিশে থাকে ভালবাসা, স্মৃতি আর ইতিহাস।
মাছ শুধু পাতে নয়, উঠে আসে সাহিত্যে, কবিতায়, উপকথায়। রবীন্দ্রনাথের “মাছের ঝোল” আর বিভূতিভূষণের গ্রামীণ গল্পে ভাতের সঙ্গে টাটকা শোল মাছ যেন জীবনের প্রতিচ্ছবি। কবি-সাহিত্যিকদের লেখায় মাছ ও ভাতের প্রসঙ্গ এসেছে বহুবার। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে আজকের লেখকরাও বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতির কথা তুলে ধরেছেন।
গ্রামবাংলার সন্ধ্যায় পুকুরঘাটে জাল টেনে ওঠে শুধু মাছ নয়, ওঠে পারিবারিক গল্প, ভালবাসা আর গ্রামীণ জীবনের নিঃশব্দ ছন্দ। তবে “মাছে ভাতে বাঙালি” শুধু খাদ্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাঙালির সংস্কৃতি, সামাজিকতা ও সাহিত্য। বাঙালির বিয়ে-শাদিতে, উৎসব-অনুষ্ঠানে মাছের উপস্থিতি যেন বাধ্যতামূলক। নববধূর বাড়িতে মাছ পাঠানো, অতিথি আপ্যায়নে মাছের কদর, এমনকি পূজার ভোগেও মাছের উল্লেখ, এসবই এই সংস্কৃতির অংশ।
উৎসব-অনুষ্ঠান মানেই বাঙালির রান্নাঘরে মাছের উল্লাস। বিয়ের পদে বড় রুই মাছ যেন নবদম্পতির সুসম্পর্কের প্রতীক। পয়লা বৈশাখে ইলিশ ভাত যেন নতুন বছরের প্রতিশ্রুতি। এমনকি “মাছে-ভাতে মেয়ে” বলেই প্রশংসা করা হয় সহজ সরল, গৃহস্থালি জীবন ভালোবাসা মেয়ের।
বিদেশ বিভুঁইয়ে থাকা বাঙালিও স্বপ্ন দেখে- এক প্লেট গরম ভাত, তার পাশে ঝালঝোল মাছের গন্ধ। যেন বিদেশের ধোঁয়াটে ব্যস্ত জীবনে একটু ‘বাংলা’র স্পর্শ।
আজকের জগত বদলেছে। চিপস, পিজ্জা, বার্গার এসেছে বাজারে। কিন্তু বাঙালির আত্মা আজও খুঁজে ফেরে সেই কাঁশবনের পাশে মাটির বাড়ি, ধানখেতের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী, আর দুপুরবেলার সেই গরম ভাতের ধোঁয়া।
যদিও আধুনিক জীবনযাত্রা ও নগরায়ণের ফলে বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে, তবুও মনের গভীরে মাছ-ভাতের প্রতি টান আজও অমলিন। প্রবাসে থাকা বাঙালিরাও মাছে ভাতে ফিরে যেতে চায়, খোঁজে একটুকরো ‘বাংলা’র স্বাদ।
সবশেষে বলা যায়, “মাছে ভাতে বাঙালি” শুধু একটি প্রবাদ নয়, এটি একটি জাতির আত্মপরিচয়, সংস্কৃতি, ও ভালোবাসার প্রতীক। যতই সময় এগিয়ে যাক, মাছ আর ভাত থাকবে চিরকাল বাঙালির হৃদয়ে, রসনায় ও ইতিহাসে। কারণ “মাছে ভাতে বাঙালি” এই একটি বাক্য যেন এক কবিতা, এক ছবি, এক জীবন। এতে আছে বাংলার আবহমান সংস্কৃতি, স্মৃতি, সুগন্ধ আর হৃদয়ছোঁয়া সহজতা। যতদিন বাংলা থাকবে, ততদিন বাঙালি তার ভাত-মাছকে ভালোবেসে যাবে- মা যেমন তার সন্তানের মুখে প্রথম গ্রাস তুলে দেন, তেমনি। এ এক প্রেম, যা কেবল পেটে নয়, প্রাণে বাজে।