
মেহেরপুর সরকারি কলেজ মোড়ে একটি জমি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে প্রশাসনিক মহল পর্যন্ত চলছে উত্তেজনা । জমিটি একক ব্যক্তি মালিকের পৈতৃক সম্পত্তি, নাকি এটি পৌরসভার -এই প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়েছে শহরের সাধারণ মানুষ, রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও প্রশাসন। এ ইস্যুকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাল্টাপাল্টি স্ট্যাটাস, খোলা চিঠি, এবং শেষ পর্যন্ত অনশনের ঘোষণায় পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে হয়ে উঠেছে।
গত ২১ জুলাই ২০২৫, মেহেরপুর পৌরসভার সাবেক মেয়র মোতাচ্ছিম বিল্লাহ মতু তাঁর ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্টে একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাস দেন, যার শিরোনাম ছিল-“পৌর সম্পত্তি রক্ষায় পৌরবাসীর প্রতি খোলা চিঠি”। সেখানে তিনি দাবি করেন, কলেজ মোড়ের পোস্ট অফিস ও তুলা ভবনের সামনের জায়গায় রাতারাতি বেআইনিভাবে কিছু দোকানঘর নির্মাণ করা হয়েছে, যা পৌরসভার মালিকানাধীন সম্পত্তি। তিনি অভিযোগ করেন, ০১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা মো. মহাব্বত আলী জমিটি নিজের বলে দাবি করে আদালতে মামলা করলেও, তৎকালীন জেলা জজ জমিটি পৌরসভার বলে রায় দিয়েছিলেন। মামলার আপিল এখনো বিচারাধীন।
সাবেক মেয়র অভিযোগ করেন, “আদালতের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো ব্যক্তি সেখানে নির্মাণ করতে পারে না। পৌরসম্পত্তি আত্মসাৎ করতে মহাব্বত আলী মিথ্যা দাবি করছেন এবং তার ঘনিষ্ঠতা কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বেআইনিভাবে ঘর নির্মাণ করছেন।”
তিনি আরও লেখেন, “দশ দিনের মধ্যে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে আমরা পৌরবাসীকে সাথে নিয়ে আমরণ অনশন কর্মসূচি পালন করবো। বর্তমান পৌর প্রশাসকের কাছে আমাদের প্রত্যাশা, তিনি যেন জনগণের স্বার্থে, পৌরসভার সম্মান রক্ষায় সাহসী ভূমিকা রাখেন।”
এদিকে, সাবেক মেয়রের স্ট্যাটাসের পরদিনই, জমির বর্তমান মালিক দাবিদার মো. মহাব্বত আলীর ছেলে ইয়াসিন আলী মারুফ তার ব্যক্তিগত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট ‘মারুফ উদয়’ থেকে একটি পাল্টা স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি সাবেক মেয়রের উদ্দেশে লিখেছেন, “আপনার মত একজন নামাজী, শিক্ষিত মানুষ থেকে এ ধরনের আচরণ আশানুরূপ নয়। আপনি যদি প্রমাণ দিতে চান, তা ফেসবুকে না দিয়ে আদালতেই দিন।”
তিনি আরও লেখেন, “জমিটি আমাদের পৈতৃক, যার সব দলিল, খতিয়ান, রেকর্ড ও খাজনার প্রমাণ আমাদের কাছে আছে। আপনি নিজেও জানেন, গনপূর্ত, পোষ্ট অফিস ও তুলা উন্নয়ন বোর্ডের জমি অধিগ্রহণ হয়েছে মূল জমির ভেতর থেকে, সামনের অংশটি কখনোই অধিগ্রহণ হয়নি।”
মারুফ তার পোস্টে সাবেক মেয়রের উদ্দেশে আরও অভিযোগ করেন, “আপনি আমাদের বিরুদ্ধে মব সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। এমনকি শোনা যাচ্ছে, আপনি বা আপনার অনুসারীরা আমাদের দোকান ভাঙতে পারেন। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।”
মহাব্বত আলী দাবি করে মেহেরপুর প্রতিদিনকে বলেন, তার দাদা আজহার শেখ ও পিতা আসাদুর রহমানের কাছ থেকে ১৯৬০ ও ৮০-র দশকে পর্যায়ক্রমে গণপূর্ত বিভাগ, পোস্ট অফিস ও তুলা উন্নয়ন বোর্ড জমি অধিগ্রহণ করে। তাতে রাস্তার সামনের অংশ বাদ যায়, যা তাদের নামে থেকে যায়। ২০০২ সালে আদালত তাদের পক্ষে রায় দেন। এছাড়া আমরা নিয়মিতভাবে জমির খাজনা পরিশোধ করে আসছি এবং জমিটি আমাদের দখলে রয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, তৎকালীন সময়ে সাবেক মেয়র মোতাচ্ছিম বিল্লাহ মতু আমার কাছে ৫ শতক জমি চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম এটা আমাদের মালিকানা জমি। জমি দেওয়ার প্রশ্নই আসেনা। পরবর্তীতে আমি ২০২২ সালে আমার ছেলে মারুফকে জমি দলিল করে দিই, যার দলিল নম্বর ২০৩৫/২২ এবং খতিয়ান ১৩২০৬।
মহাব্বত আলী আরও বলেন, তৎকালীন সময়ে সাবেক মেয়র জমিটি দখলে চেষ্টা করলে তাঁর বড় ভাই মো.শাফায়েত হোসেন ২০০৬ সালে মেহেরপুরের যুগ্ম জেলা জজ ১ম আদালতে মেহেরপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান ও সচিব বিবাদী করে জমিটি তাদের দাবী করে একটি মামলা দায়ের করেন। সেই মামলাটি এখনো বিচারাধীন রয়েছে। গত ৩১ জুলাই সংগ্রহ করা আদালতের একটি আদেশ স্লিপ থেকে জানা গেছে, মামলাটি বিচারাধীন এবং মেহেরপুর পৌরসভার বিপক্ষে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ রয়েছে।
এ বিষয়ে সহকারী ভূমি কর্মকর্তা ওহিদুর রহমান জানান, “মহাব্বত আলী বর্তমানে নিয়মিত খাজনা দিচ্ছেন এবং জমিটি তাদের নামে রয়েছে।”
মেহেরপুর পৌরসভার প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. তরিকুল ইসলাম বলেন, “যেহেতু জমিটি নিয়ে আদালতে মামলা বিচারাধীন, বাদির পক্ষে আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে, সেহেতু আদালতের আদেশ অমান্য করার সুযোগ নেই।”