
গতকাল রোববার দিনের সিংহভাগ সময় কাটালাম নারায়ণগঞ্জ জেলার সোনারগাঁয়ে অবস্থিত প্রাচীন শহর পানাম সিটিতে। পানামা যেন হারিয়ে যাওয়া এক গৌরবগাথার জীবন্ত স্মৃতি। ইতিহাস, স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের অপূর্ব সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা এই শহরটি আজো দাঁড়িয়ে আছে শ শ বছরের পুরনো অনেক গল্প নিয়ে।
১৫শ শতকে প্রতিষ্ঠিত এই নগরী মধ্যযুগে বাংলার অন্যতম প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। সুলতানি ও মুঘল আমলে সোনারগাঁ ছিল বাংলার রাজধানী, আর পানাম ছিল সেই রাজধানীর গৌরবময় আবাসভূমি। বিশেষ করে হিন্দু জমিদার ও ব্যবসায়ীদের আধিপত্যে গড়ে ওঠা পানাম নগরীতে ইউরোপীয়, মুঘল ও বাংলা স্থাপত্যরীতির অপূর্ব মিশ্রণ দেখা যায়।
বর্তমানে পানাম নগরীতে প্রায় ৫২টি ঐতিহাসিক ভবন রয়েছে, যেগুলোর প্রতিটিই একেকটি স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন। সড়কের দু’পাশে সারি সারি দালান যেগুলোর দেয়ালে আজও জেগে আছে পুরোনো দিনের কারুকাজ, রঙিন কাচের জানালা, কাঠের ফ্রেম আর চুন-সুরকির প্রাচীন প্রযুক্তির ছাপ। জমিদারের ৫ শ মিটার পুকুর। পুকুরে অনেকগুলো গোসলের জন্য সানবাঁধানো সিঁড়ি। সেই সময়ের সুপেয় পানির বেশ কটি পাকা কুয়া। কালের সাক্ষি হয়ে পড়ে আছে পাকা পায়খানা।
সংস্কারহীনতায় হারাতে বসেছে সেসব ঐতিহ্য।
যদিও ২০০৬ সালে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর পানাম সিটিকে “সংরক্ষিত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান” হিসেবে ঘোষণা করেছে, বাস্তবতা হলো অনেক ভবন আজ ধ্বংসপ্রায়। অবহেলা, যথাযথ সংরক্ষণের অভাব এবং পর্যটন চাপে এই ঐতিহ্যবাহী স্থানটি হুমকির মুখে পড়েছে।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন সংস্কারের উদ্যোগ না নেওয়ায় অনেক ভবন ধসে পড়েছে। বৃষ্টির মৌসুমে পানিতে ভিজে কাঠ ও চুন-সুরকির দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অপরিকল্পিত পর্যটন ও স্থানীয় দখলদারদের কারণে ঐতিহাসিক পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।
পানাম নগরী বর্তমানে দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন শত শত দর্শনার্থী এখানে ভিড় করেন ইতিহাস ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু পর্যাপ্ত গাইড, তথ্যচিত্র, পর্যটক ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের ঘাটতি দেখলাম।
পর্যটন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যদি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে পানাম সিটি হতে পারে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম সফল হেরিটেজ ট্যুরিজম স্পট।
কেয়ার টেকার রফিকুল ইসলাম জানালেন-পানাম সিটি শুধু একটি পুরনো শহর নয়, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমূল্য দলিল। এই নগরীর দেয়ালে লেগে আছে বাঙালি জাতির শিল্প, সংস্কৃতি ও সংগ্রামের ছাপ। প্রয়োজন এখন শুধু সময়োচিত উদ্যোগ, সচেতন সংরক্ষণ এবং সম্মিলিত দায়িত্ববোধ।
পানামকে যদি সময়মতো বাঁচানো যায়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই গৌরবময় ইতিহাসের সাক্ষী হতে পারবে-নয়তো এটি হারিয়ে যাবে কালের অতলে, আর আমরা হারাবো এক অপূর্ব ঐতিহ্য।