
ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শেখানো হয় “ওখানে যাবে না, ওটা সেইফ না”, “ওটা করবে না, সেইফ না”। “চুপ করে থাকো, তবেই সবাই তোমায় ভালো বলবে।” “বেশি কথা বলো না, বেশি হাসো না, বেশি মিশো না।” তুমি মেয়ে এখানে চলবে না, তুমি মেয়ে ওভাবে বলবেনা,মাথা নামিয়ে, চলো, নিচু স্বরে কথা বলো, তা না হলে লোকে খারাপ বলবে। প্রথমে মা, চাচী, দাদী বলে পরে পাড়া পড়শী মহিলারা।
যেন একটা শব্দহীন শিকল নারীর পায়ে বেড়ি দিয়েছে। যেন শব্দহীন লোহার বেড়ি নারীর গলাটাকে আটকে ধরেছে। ভালো মেয়ে হতে যেয়ে “না” শব্দের দৃশ্যহীন মালা গলায় পরে নিতে হয়েছে। এই “না” শব্দটার মাঝে অসহায়ত্বকে ফুটিয়ে তুলে বার বার স্মরণ করিয়ে দেয় তোমাকে ভালো মেয়ে হতে হবে। ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই নারীর পায়ে ভালো মেয়ের শব্দহীন শিকল বেঁধে রেখেছে। আসলে আমরা নারীরা ছোটবেলা থেকেই নিজেদের কন্ডিশন করে ফেলি, কোনটা ভালো, কোনটা মন্দ, কোনটা সেইফ, বা কোনটা সেইফ না। কন্যা শিশু জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই এই কন্ডিশনিংটা ভূতের মতো বাবা-মা-পরিবারের সবার ঘাড়ের ওপরেই চেপে বসে।
সমাজে “ভালো মেয়ে” বলতেই আমরা এক ধরনের নির্দিষ্ট ছাঁচে গড়া নারীর চিত্র কল্পনা করি — যে ভদ্র, শান্ত, পর্দানশীল, সংসারী, বাধ্য, পুরুষের কথা নিঃশর্তে মেনে চলে। ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের শেখানো হয় — “এভাবে বসো না”, “জোরে কথা বলো না”, “রাতে বাইরে যেও না”, “ছেলেদের সঙ্গে বেশি মিশো না”, “ভালো মেয়ে এমন হয় না। ”ভালো মেয়ে সে–ই, যে চুপচাপ থাকে, প্রতিবাদ করে না, সবার কথা মেনে চলে, নিজের চাওয়া-পাওয়ার কথা প্রকাশ করে না। সমাজের চোখে যে মেয়ে বিনয়ী, বাধ্য, নিরব, আজ্ঞাবহ — তাকেই ভালো বলা হয়। কিন্তু এই ধারণা মেয়েদের নিজের চিন্তা, মতামত ও স্বপ্নকে চাপা দেয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো — এই “ভালো মেয়ে” ধারণা কি সত্যিই নারীর গুণ, নাকি সমাজের এক অদৃশ্য শিকল?
এই “ভালো মেয়ে” হওয়ার শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই মেয়েদের মনে গেঁথে দেওয়া হয়। ফলে মেয়েরা বড় হয় এক ধরনের অন্তর্নিহিত ভয়, বাধ্যতা আর অপরাধবোধ নিয়ে। অর্থাৎ, সমাজ মেয়েদের ভদ্রতা শেখায়, কিন্তু আত্মবিশ্বাস শেখায় না। ফলে তারা বড় হয়ে ভাবে, নিজের ইচ্ছা প্রকাশ করা মানেই অন্যায় করা। একজন ছেলেকে যখন বলা হয় “তুমি পারবে”, তখন একজন মেয়েকে বলা হয় “তুমি সাবধান থাকো।” ছেলেদের শেখানো হয় “সাহসী হও”, “বলো”, “লড়ো”, কিন্তু মেয়েদের বলা হয় “চুপ থাকো”, “সহ্য করো”, “ভদ্র থাকো”। ফলে একটা সময় পরে মেয়েরা বুঝে ফেলে, সমাজের ভালোবাসা পেতে হলে তাকে নিজের ব্যক্তিত্ব গোপন রাখতে হবে।
সে নিজের ভাবনা লুকিয়ে রাখে, কারণ সমাজ তার চিন্তা, রাগ, বা প্রতিবাদকে গ্রহণ করতে জানে না। এই এক কথার পার্থক্যই তৈরি করে দুই ধরনের জীবনদর্শন।
“ভালো মেয়ে” শব্দটা কখনোই মেয়েদের জন্য নয়। এটা সমাজের সুবিধার জন্য তৈরি করা একটি নিয়মের ছাঁচ। যাতে নারীকে সহজে নিয়ন্ত্রণ, বিচার ও সীমাবদ্ধ করা যায়। “ভালো মেয়ে” ধারণা সমাজের এক ধরনের নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র। এর মাধ্যমে মেয়েদের স্বাধীন চিন্তা, পছন্দ-অপছন্দ, এমনকি জীবনযাপনের ধরনও নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই ধারণা ধীরে ধীরে নারীদের আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান, এমনকি তাদের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতাকেও দুর্বল করে দেয়। এটা একরকম মানসিক শৃঙ্খল — যা নারীর ভেতরের শক্তিকে চুপ করিয়ে রাখে “ভদ্রতার” নামে।
যখন কোনো মেয়ে নিজের মতো করে বাঁচতে চায়। নিজের পছন্দের পোশাক পরে, ক্যারিয়ার গড়ে, বা সম্পর্ক নিয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। তখন সমাজ বলে, “ও খুব বেপরোয়া!”। যে মেয়েটি নিজের মতামত প্রকাশ করে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়, সে অনেক সময় সমাজের চোখে “খারাপ মেয়ে” হয়ে যায়। যে মেয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখ খোলে, সে সমাজে “অভদ্র”, “বেশি কথা বলে”, “অবাধ্য” বলে চিহ্নিত হয়।
অর্থাৎ, সমাজ চায় ভদ্র মেয়ে, কিন্তু চায় না সচেতন নারী।
অর্থাৎ সমাজ চায় না নারী স্বাধীনভাবে ভাবুক বা সিদ্ধান্ত নিক, বরং সমাজ চায় সে সম্মত হোক, বাধ্য থাকুক, নিরব থাকুক। সমাজের মতো করে বাঁচতে যেয়ে, সমাজে ভালো মেয়ে হতে যেয়ে মেয়েরা আত্নবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। লোকে কিভাবে ভালো বলবে-এই মানসিকতা নারীর মানসিক বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। সে নিজের স্বাধীন চিন্তাকে অপরাধ মনে করতে শুরু করে। ফলে মেয়েরা দুটি জীবনে বাস করে। একটি সমাজের সামনে “ভালো মেয়ে” সেজে থাকা, আর অন্যটি নিজের মধ্যে অবদমিত, ক্লান্ত, স্বপ্নহীন এক সত্তা।
এভাবেই “ভালো মেয়ে” হওয়ার চাপ নারীর আত্মপরিচয়কে ক্ষয় করে ফেলে। অর্থাৎ, সমাজের চোখে ভালো মেয়ে সেই, যে সমাজের নিয়মে বাঁচে, নিজের নিয়মে নয়।
অন্যদিকে, কেউ কেউ বলেন — “ভালো মেয়ে” ধারণা সংস্কৃতির অংশ, যা শালীনতা, সহনশীলতা, সৌজন্য, পারিবারিক মূল্যবোধকে টিকিয়ে রাখে। “ভালো মেয়ে” ধারণা সংস্কৃতির অংশ, যা শালীনতা, পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক মূল্যবোধকে রক্ষা করে। তাদের মতে, সমাজে সৌহার্দ্য বজায় রাখতে কিছু নিয়ম থাকা দরকার — যেমন বয়োজ্যেষ্ঠদের সম্মান, দায়িত্বশীলতা, সহমর্মিতা ইত্যাদি। কিন্তু সমস্যা হয় যখন এই মূল্যবোধগুলো কেবল মেয়েদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয় এবং মেয়েদের চরিত্র বিচার হয় তাদের পোশাক, সময় ব্যবস্থাপনা বা সামাজিক আচরণের ওপর; অথচ ছেলেদের জন্য এমন কোনো কঠোর মানদণ্ড নেই।
সংস্কৃতি তখন ন্যায্য থাকে না, বরং হয়ে ওঠে পক্ষপাতদুষ্ট। এইভাবে “ভালো মেয়ে” ধারণা নারীদের উপর নৈতিক পুলিশিংয়ের হাতিয়ার হয়ে দাঁড়ায়। অনেকে বলেন — “ভালো মেয়ে” ধারণা সংস্কৃতির অংশ, যা শালীনতা, পারিবারিক বন্ধন ও সামাজিক মূল্যবোধকে রক্ষা করে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, যদি সেই সংস্কৃতি নারীর স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, তবে সেটা সংস্কৃতি নয় বরং যুগ যুগ ধরে চলা সামাজিক শাসনের রূপ। সংস্কৃতি কখনোই একপাক্ষিক হতে পারে না। যেখানে ছেলেদের স্বাধীনতা প্রশংসিত, আর মেয়েদের স্বাধীনতা প্রশ্নবিদ্ধ। সেই জায়গায় সংস্কৃতি নয়, দ্বিচারিতা কাজ করছে।
অনেকে বলে, এটি আমাদের সংস্কৃতির অংশ।মেয়েরা নম্র, ভদ্র, লাজুক হবে — এটাই তো আমাদের ঐতিহ্য। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সংস্কৃতি কাকে বলে?
সংস্কৃতি তো জীবনের সৌন্দর্য ও সমতার প্রতিফলন,যে চিন্তা নারীর কণ্ঠরোধ করে, তাকে কষ্ট দেয়, তাকে ছোট করে, তা কোনো সংস্কৃতি নয়, তা সমাজের তৈরি শিকল। যদি সংস্কৃতি নারীর স্বাধীনতা কেড়ে নেয়, তবে সেটা সংস্কৃতি নয় বরং যুগ যুগ ধরে চলা সামাজিক শাসনের রূপ।
আজকের পৃথিবীতে মেয়েরা আর সেই পুরনো মানদণ্ডে আটকে নেই। তারা জানে — ভালো মেয়ে হওয়া মানে কারো সামনে নত হওয়া নয়,বরং নিজের প্রতি সত্য থাকা। ভালো মেয়ে সে-ই, যে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, কিন্তু নিজের সম্মান নিয়েও সচেতন।
তারা ভালোবাসে, কিন্তু ভালোবাসার নামে নিজের স্বপ্ন বিসর্জন দেয় না। তারা ডাক্তার, প্রকৌশলী, সাংবাদিক, সৈনিক, উদ্যোক্তা, তারা মা-ও, কর্মীও, আর নিজের পৃথিবীর অধিনায়কও।
তারা প্রমাণ করছে — “ভালো মেয়ে”র সংজ্ঞা এখন নতুন করে লিখতে হবে। যেখানে স্বাধীনতা অপরাধ নয়, আর স্বপ্ন বিলাসিতা নয়।