
শিক্ষা জাতীর মেরুদণ্ড, একটি জাতির ভিত্তি বলা হয়। শিক্ষকদের নৈতিকতা, সততা ও আদর্শই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ গঠনের মূলে থাকে।
সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে মেহেরপুর সদর উপজেলার বর্শিবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ পাঁচ শিক্ষক দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে জাল বিএড সনদ ব্যবহার করে অতিরিক্ত বেতন গ্রহণ করেছেন। এ খবর শুধু দুঃখজনকই নয়, বরং দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা ও সম্মানকে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। এবং একই সঙ্গে সরকারি টাকা আত্মসাতের মধ্যে ফৌজদারী অপরাধও বটে। যা চাকরিবিধির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।
২০১৯ সালে বিদ্যালয়টি এমপিভুক্ত হওয়ার পর থেকেই জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ব্যবহার করে জাল সনদ দেখিয়ে তারা উচ্চতর স্কেলে বেতন গ্রহণ করে আসছেন। অথচ বাস্তবে তারা বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের যশোর কেন্দ্র থেকে এখনো বিএড অধ্যয়নরত এবং মাত্র প্রথম সেমিস্টার শেষ করেছেন। এই তথ্য নিজেই প্রমাণ করে তারা সুস্পষ্ট প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে সরকারি তহবিল থেকে প্রায় ১২ থেকে ১৪ লাখ টাকা অতিরিক্ত অর্থ আত্মসাৎ করেছেন।
অধিকতর উদ্বেগজনক হলো, বিদ্যালয়ের আরেক সহকারী শিক্ষক আখি তারা খাতুন জাল সনদ দিয়ে চাকরি নেওয়ার অপরাধে জেল খেটে এসেছেন, তবুও হাজিরা ছাড়া তাকে বেতন প্রদান করা হয়েছে। প্রধান শিক্ষকের পদে থেকে এ ধরনের অনিয়মে সমর্থন দেওয়া কেবল নৈতিক অধঃপতন নয়, বরং প্রশাসনিক ক্ষমতার স্পষ্ট অপব্যবহার।
একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যখন শিক্ষকই অনিয়মের মাধ্যমে সুবিধা গ্রহণ করেন, তখন শিক্ষার্থীদের কাছে সততা ও নৈতিকতার যে শিক্ষাটি দেওয়ার কথা, তা ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, এই ধরনের ঘটনা দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থা, নিয়োগ প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও আর্থিক শৃঙ্খলা—সবই প্রশ্নবিদ্ধ করে।
ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বক্তব্য অবশ্যই আশাব্যঞ্জক। তিনি বলেছেন, অভিযোগ প্রমাণিত হলে অতিরিক্ত বেতন সরকারি কোষাগারে ফেরত আনা হবে এবং আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে প্রশ্ন থেকে যায়—এই অনিয়ম পাঁচ বছর ধরে কীভাবে চললো? পর্যবেক্ষণ, অডিট ও তদারকি ব্যবস্থায় কি কোনো ঘাটতি ছিল? ইতিপূর্বে যারা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন এমনকি শিক্ষা কর্মকর্তারা কি সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করেননি এমন প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে। প্রধান শিক্ষকসহ ওই পাঁচ শিক্ষকের নিয়োগের ক্ষেত্রে যারা ভূমিকা পালন করেছেন তাদেরও এ জবাদদিহীতার মধ্যে আনতে হবে।
এই ঘটনার দ্রুত, নিরপেক্ষ ও কঠোর তদন্ত হওয়া জরুরি। কেবল অতিরিক্ত টাকা ফেরত আদায়ে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না; বরং এমন উদাহরণ তৈরি করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কোনো শিক্ষক বা প্রশাসনিক ব্যক্তি জাল সনদ বা প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার সাহস না পায়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নৈতিকতার চর্চার জায়গা। এখানে ভুয়া সনদ, বেতন জালিয়াতি এবং কর্তৃপক্ষের গাফিলতি—সব মিলিয়ে যে অস্থির চিত্র ফুটে উঠেছে, তা এখনই সংশোধন না হলে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।


