
পৃথিবীতে প্রতি রাতে ৮০ থেকে ৮৩ কোটির বেশি মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থা ঘুমাতে যায় যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার কম- বেশি ১০ শতাংশ এবং এই সংখ্যা দিন দিন বেড়েছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা ৮.২ বিলিয়ন বা ৮২০ কোটিরও বেশি। বাংলাদেশের জনসংখ্যা কম-বেশি ১৮ কোটি। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে দেশে চার বছর ধরে দারিদ্র্যের হার বাড়ছে। সংস্থাটির মতে বর্তমানে দেশে দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশের কিছু বেশি। সে হিসেবে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কম-বেশি ৩ কোটি ৬০ লাখ। দেশের জনসংখ্যার বড়ো একটি অংশ দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকে। তারা উচ্চ মূল্যস্ফীতির মতো বিভিন্ন আঘাতের কারণে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে ২০২২ সালে সংখ্যাটি ছিল ৬ কোটি ২০ লাখ। ২০২৫ সালের বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে (GHI) বাংলাদেশের অবস্থান ৮৫তম, যা ১২৩টি দেশের মধ্যে ‘মাঝারি’ (Moderate) ক্ষুধার ক্যাটাগরিতে পড়েছে এবং স্কোর ১৯.২, যা ২০২৪ সালের তুলনায় কিছুটা ভালো। তবে, জাতিসংঘের ‘গ্লোবাল রিপোর্ট অন ফুড ক্রাইসিস ২০২৫’ অনুযায়ী, তীব্র খাদ্য সংকটে থাকা শীর্ষ ৫ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ চতুর্থ অবস্থানে আছে। ভারত (১০২তম) ও পাকিস্তানের চেয়ে ভালো অবস্থানে থাকলেও নেপাল ও শ্রীলঙ্কার চেয়ে পিছিয়ে আছে।
বিশ্বে প্রতিদিন না খেয়ে থাকা মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে,যা খুবই হতাশার সংবাদ। বিশ্বে প্রতিদিন যে পরিমান খাবার মানুষ অপচয় করে তা দিয়ে কম-বেশ ১০০ কোটি মানুষকে খাওয়ানো যেতো। অর্থাৎ প্রতিদিন প্রায় ১০০ কোটি মানুষের খাবার নষ্ট হয়, যা বিশ্বব্যাপী উৎপাদিত মোট খাদ্যের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ । যেখানে কোটি কোটি মানুষ অনাহারে থাকে সেখানে এটা ভাবাও চরম বিলাসিতা। এই অপচয় পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে প্রায় ৯০ কোটি মানুষ গুরুতর খাদ্য সংকটে ছিল এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এই সংখ্যা ৬০ কোটিতে পৌঁছানোর আশঙ্কা রয়েছে। ধনী দেশগুলোর আর্থিক সাহায্য কমে যাওয়া, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সংঘাতের কারণে এই অভুক্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ২০২৪ সালে জাতিসংঘ মানবিক সাহায্যের জন্য চার হাজার ৯৬০ কোটি টাকা তুলতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ৪৬ শতাংশ অর্থ তুলতে পেরেছিলো। অর্থের অভাবে জাতিসংঘ মানবিক সাহায্য সংস্থা প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও অভুক্ত মানুষের কাছে খাবার পৌঁছাতে পারে নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিট (এফপিএমইউ) ও জাতিসংঘের তিন সংস্থা রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ দেশের ৩৬ জেলার ৯ কোটি ৬৬ লাখের বেশি মানুষের খাদ্যনিরাপত্তা ও পুষ্টি অবস্থা বিশ্লেষণ করে গত ৩০ অক্টোবর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
এ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ডিসেম্বরের মধ্যে দেশের দুর্যোগপ্রবণ জেলাগুলোর ১ কোটি ৬০ লাখ মানুষ বড়ো ধরনের খাদ্যসংকটে পড়তে যাচ্ছে। আর চরম অপুষ্টির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে ১৬ লাখ শিশু। বাংলাদেশে জনসংখ্যার অর্ধেক নারী এবং কম-বেশি দুই-তৃতীয়াংশ কর্মক্ষম। এটি ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের সুফল অর্জনের একটি সুযোগ। জনসংখ্যার ৭ শতাংশ প্রায় ১.২ কোটি মানুষ ৬৫ বছর বা তার বেশি বয়সি, যা বয়স্ক জনগণের সংখ্যা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দিচ্ছে। জনসংখ্যার ১৯ শতাংশ কম-বেশি ৩ কেটি ৫০ লাখ কিশোর-কিশোরী এবং ১০ থেকে ২৪ বছর বয়সি তরুণের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি যা জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ। চরম অপুষ্টির সম্মুখীন হতে যাচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম।
খাদ্য অপচয়কে বুঝতে হলে ‘ফুড লস’ ও ‘ফুড ওয়েস্ট’ বুঝতে হবে। যখন শস্যদানা যেমন চাল-গম-ডাল, সবজি ও ফল, বিভিন্ন প্রাণীর মাংস, ডিম বা দুধ এসব উৎপাদনের পর বাজারজাতকরণ পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে যেসব অপচয় হয় তাকে ‘ফুড লস’ বলে। কিন্তু যখন এসব খাবার বাড়ি বা রেস্তোরাঁ বা কমিউনিটি সেন্টারে রান্নার পর অপচয় হয় তখন সেটিকে ‘ফুড ওয়েস্ট’ বলা হয়। খাবার নষ্ট করা কোনো বিবেচনাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। যদিও অনেক সময় ইচ্ছা না থাকলেও খাবার নষ্ট হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু খাবার নষ্টে মানসিকতাও অনেকটা দায়ি। হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোয় বুফে খেতে গিয়ে অনেক খাবার নষ্ট হয়। কোনো অনুষ্ঠানে প্রয়োজনের বেশি রান্না করা হয়, সেগুলোর অনেকটাই ডাস্টবিনে চলে যায়। শিল্পপ্রধান দেশগুলোতে প্রধানতঃ দোকান, বাসা ও খাওয়ার টেবিলে খাদ্যের অপচয় হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ফসল সংগ্রহ করার অদক্ষ পদ্ধতি, অপর্যাপ্ত খাদ্য গুদাম ও খাদ্য হিমায়িত রাখার অপ্রতুল ব্যবস্থা অথবা ক্ষেত থেকে বাজারের খাদ্য নিয়ে যাওয়ার সমস্যার কারণে ক্ষেত থেকে বের হবার আগেই বেশিরভাগ খাদ্যের অপচয় হয়।
খাদ্যের অপচয় রোধ করা এই মুহূর্তে মানবতার সবচেয়ে বড়ো চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে একটি। জীবন ধারণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে খাবার। খাবার অপচয় করার অর্থ হলো ক্ষুধার্ত এবং গরিবের মুখ থেকে কেড়ে নেয়া। কোনো এক সময় প্লেটের সব খাবার শেষ করে খেতে না পারা স্বাভাবিক ব্যাপার হতে পারে । কিন্তু অনেকে আছেন যাদের খাবার অপচয় করা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, প্রতিবারেই তারা প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার নিচ্ছে এবং অপচয় করছে যা একটা গুরুতর সমস্যা। তবে খাবার অপচয়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা খুব সহজ বিষয় নয়। তাহলে কীভাবে খাবার অপচয় রোধ করা সম্ভব। প্রথমত সবাইকে খাবার অপচয় সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সচেতনতার কোনো বিকল্প নেই। আমরা প্রতিদিন যত খাবার কিনি বা তৈরি করি তার কম-বেশি ১৪ শতাংশ খাবারই অপচয় হয়। শুধু খাবার অপচয় হলে যে ক্ষতি হয়, তার চেয়ে আরও বেশি ক্ষতি হয় পরিবেশের পঁচে যাওয়া খাবার থেকে যে পরিমাণ গ্রীন হাউস গ্যাস (মিথেন) নির্গত হয়, তা কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে প্রায় ২৫ গুণ বেশি ক্ষতিকারক।
বিশেষজ্ঞরা খাদ্যের অপচয় রোধে কিছু টিপস দিয়েছেন। এগুলো ফলো করলে একদিকে যেমন খাদ্যের অপচয় রোধ করা সম্ভব,তেমনি আর্থিকভাবেও লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। এ জন্য নিজেকে একটু স্মার্ট’ হতে হবে।বাজার করার আগেই জেনে নিতে হবে বাড়িতে কী আছে,আর কি নাই। আর প্রয়োজনইবা কতোটুকু। যা প্রয়োজন, কেবল ততটুকুই কিনতে হবে। বিশেষ করে পচনশীল খাবার কেনার সময় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। প্রয়োজনের তালিকা করে নিয়ে বাজারে যেতে হবে। রোজ কতটা খাবার বা খাদ্য উপকরণ ফেলে দেওয়া হচ্ছে সেটিরও খেয়াল রাখতে হবে। তাহলে সহজেই বুঝা যাবে কতটা অপচয় রোধ করার সুযোগ আছে । খাওয়ার সময় প্লেটে ততটুকুই খাবার নিতে হবে, যতটা খাওয়া সম্ভব ।
খাবার সংরক্ষণে যত্নবান হতে হবে। ফ্রিজ ও ডিপফ্রিজ নিয়মমাফিক পরিষ্কার রাখতে হবে। একসঙ্গে অনেক খাবার ফ্রিজে বা ডিপফ্রিজে না রাখাই ভালো আর যদি রাখতেই হয় তবে খাবারের ধরণ অনুযায়ী সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ফ্রিজে খাবার রাখার সময় আইটেম অনুযায়ী খাবার সাজিয়ে রাখতে হবে। এতে কোনো খাবার চোখের আড়ালে থাকবে না। খাওয়ার অযোগ্য হওয়ার আগেই সেটার সদব্যবহার করতে হবে। আর ফ্রিজে বা ডিপফ্রিজে খাবার সংরক্ষণ করার সময় সেসব খাবার সামনের দিকে রাখতে হবে, যেসব সহজে পচে যেতে পারে। কোনো খাবার কত দিন ভালো থাকতে পারে, তা জানতে হবে। অনেক খাবার বা খাদ্য উপকরণেরই মেয়াদ উল্লেখ করা থাকে। এসব কেনার সময় মেয়াদের মধ্যে তা ব্যবহার করার সম্ভাবনা আছে কি না তা খেয়াল করতে হবে। অনেক সময় মূল্যহ্রাসের বিজ্ঞাপন দেখে আমরা অনেক জিনিস কিনে ফেলি। এটি ভালো অভ্যাস নয়। ব্যবহার করার সম্ভাবনা না থাকলে কোনো জিনিস কম দামেও কেনা উচিত নয়। পরিবারে সদস্য সংখ্যা বিবেচনায় কার কতটা খাবার প্রয়োজন, কার কোনো ধরনের পুষ্টি উপাদান প্রয়োজন, তা বের করে খাবারের তালিকা করতে হবে। এতে বাজার করতেও সুবিধা হবে। দামি উপকরণ মানেই যে পুষ্টিকর খাবার, তা কিন্তু নয়। তুলনামূলক কম খরচে কোনো কোনো পুষ্টিকর উপকরণ কেনা সম্ভব, তা বিবেচনায় নিতে হবে। মাছ-মাংস ছাড়াও পুষ্টিকর খাদ্যতালিকা করে ফেলা সম্ভব। তাতে পরিবেশের ওপরও চাপ কমে।
বেঁচে যাওয়া উপকরণ বিশেষ করে সবজির খোসা, কাণ্ড, পাতা—এ রকম অনেক কিছুই ফেলে দেওয়া হয়, যা আসলে খাওয়া সম্ভব। প্রয়োজন মাফিক রান্নার পরও খাওয়াদাওয়ার শেষে অল্প কিছু খাবার অবশ্য থেকে যেতে পারে। সম্ভব হলে সেটি সংরক্ষণ করে পর দিন কাজে লাগাতে হবে। সম্ভব না হলে দুস্থ মানুষকে দিয়ে দিতে হবে। খাবার আয়োজনের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যতা থাকা ভালো। কিন্তু সেটা যেন প্রয়োজনের অতিরিক্ত না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।কোনো খাবার ফেলে দেওয়ার আগে একটু চিন্তা করতে হবে ,সেটা উত্পাদনে কতটা পরিশ্রম এবং সম্পদ ব্যয় হয়েছে। দুই সপ্তাহ অন্তর একবার খাতা-কলম নিয়ে হিসেব করে দেখতে হবে, এ সময়কালে কতটা খাবার নষ্ট হয়েছে এবং এতে কত টাকা অনর্থক খরচ হলো। টাকার হিসেব চোখের সামনে থাকলে খাবারের অপচয় রোধে সচেতন হওয়া সম্ভব।
খাবার নষ্ট হওয়ার বিষয়টাকে ‘বৈশ্বিক ট্র্যাজেডি’ বলে অভিহিত করা হয়। আমরা যখন বিশ্বজুড়ে খাবার নষ্ট করছি, তখন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ ক্ষুধার্ত থাকছে। বিশ্বে যে পরিমাণ খাবার নষ্ট হচ্ছে তার ৬০ শতাংশ খাবার নষ্ট হচ্ছে বাসাবাড়িতে। এ ধরনের অপচয় হওয়ার বড়ো কারণ, মানুষ তাদের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি খাবার কিনছে। এছাড়া তারা কতটুকু খেতে পারবে তার আন্দাজ করতে পারছে না। এতে খাবার উচ্ছিষ্ট থেকে যাচ্ছে। ইউএনইপি ২০২১ সালে ফুড ওয়েস্ট ইনডেক্স নামে রিপোর্ট প্রকাশ করে যাতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বছরে এক কোটি ৬ লাখ টন খাদ্য অপচয় হয়। মাথাপিছু খাদ্য অপচয়ের হারও বাংলাদেশে বেশি। ইউএনইপির ওই ইনডেক্স অনুযায়ী একজন বাংলাদেশি বছরে ৬৫ কেজি খাদ্য উপাদান কিংবা তৈরি খাদ্য নষ্ট করেন।আমাদের মতো গরিব দেশের জন্য এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তাই সবাইকে সচেতন হয়ে খাবার অপচয় রোধ করতে হবে।
লেখক: জনসংযোগ কর্মকর্তা, খাদ্য মন্ত্রণালয়


