নতুন কুঁড়িতে সেরাদের সেরা সুনামগঞ্জের শুভমিতা তালুকদার
সুর তাকে ডাকত। মঞ্চ তাকে টানত। এই টানে সাড়া দিয়েই সুনামগঞ্জের শুভমিতা তালুকদার নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। নতুন কুঁড়ির প্রতিটি ধাপেই শুভমিতা তার নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও সংগীতের প্রতি গভীর ভালোবাসার পরিচয় দিয়েছে। নতুন কুঁড়ির আলো ঝলমলে মঞ্চে দাঁড়িয়ে সে প্রমাণ করেছে—মনোযোগ, অনুশীলন ও সৃজনশীলতা থাকলে যে-কোনো প্রতিযোগিতায় সফল হওয়া যায়।
বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) আয়োজিত শিশু-কিশোরদের প্রতিভা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা ‘নতুন কুঁড়ি ২০২৫’-এ শুভমিতা তালুকদার ‘খ’ বিভাগে দেশসেরা হয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় শুভমিতা রবীন্দ্রসংগীতে প্রথম, নজরুলসংগীতে দ্বিতীয় এবং দেশাত্মবোধক গানে পঞ্চম স্থান অর্জনের মাধ্যমে বহুমাত্রিক সংগীত প্রতিভার পরিচয় দিয়েছে। একই প্রতিযোগিতায় একাধিক বিষয়ে এমন সাফল্য তার সংগীতচর্চার গভীরতা ও নিষ্ঠারই বহিঃপ্রকাশ। শুভমিতার এই অসাধারণ সাফল্যে তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, শিক্ষক, সহপাঠী সকলেই অনেক আনন্দিত হয়েছেন।
এর আগেও জাতীয় পর্যায়ে সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে শুভমিতা তালুকদার। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি আয়োজিত জাতীয় শিশু পুরস্কার প্রতিযোগিতায় শুভমিতা উচ্চাঙ্গ সংগীতে তৃতীয় স্থান অর্জন করে। ২০২৪ সালের জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্রসংগীতে সে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ছোটবেলা থেকেই তার কণ্ঠে সংগীতের যে সাবলীলতা, মনোযোগ ও আবেগের প্রকাশ দেখা যায়, তা জাতীয় মঞ্চে তাকে পরিচিত করে তোলে।
শুভমিতা ২০১২ সালের ১৪ অক্টোবর সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর উপজেলার কলুমা গ্রামে জন্মগ্রহণ করে। বর্তমানে সে সুনামগঞ্জ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী। মর্নিং শিফটের বি শাখায় শুভমিতার রোল ০১। পড়াশোনা ও সংগীত—দুটিই সমান যত্নে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করছে দেশসেরা এই শিশুশিল্পী।
শুভমিতার বাবা দ্বীপন কুমার তালুকদার এমপিওভুক্ত একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। মা শান্তনা সরকারও শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত। বাবা-মায়ের সাংস্কৃতিক অনুরাগ, উৎসাহ ও সহায়তা শুভমিতার সংগীতযাত্রাকে করেছে শক্তিশালী ও গতিময়। প্লে-গ্রুপে থাকা অবস্থায় শুভমিতা সংগীতচর্চা শুরু করে। মনের ভালো লাগা থেকে সে সংগীতচর্চা চালিয়ে যাচ্ছে। তার কাছে গান শুধু প্রতিযোগিতার প্রস্তুতি নয়, এটি তার আনন্দ, আবেগ ও আত্মপ্রকাশের অন্যতম প্রিয় মাধ্যম। সংগীতচর্চায় সে কখনো ক্লান্ত হয় না; বরং নতুন সুর শেখার আগ্রহ তাকে আরও উদ্দীপনা দেয়।
বাংলাদেশে শিক্ষকের সন্তানদের সাফল্যের হার যে তুলনামূলক বেশি—শুভমিতার ক্ষেত্রে সেটি আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে। পারিবারিক শিক্ষামূলক পরিবেশ, শৃঙ্খলার চর্চা এবং মূল্যবোধ শুভমিতাকে সংগীতে মনোযোগী ও অধ্যবসায়ী করে তুলেছে। পারিবারিক শিক্ষার এই মজবুত ভিত্তি তাকে জাতীয় পর্যায়ের সেরা হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে।
শুভমিতার গানের শিক্ষক দুজন—সন্তোষ কুমার চন্দ মন্তোষ ও অনিমেষ বিজয় চৌধুরী। গুণী এই দুই শিক্ষকের আন্তরিক প্রচেষ্টা শুভমিতার সংগীতশিক্ষার মূল ভিতকে শক্ত করেছে। তাঁরা দুজনেই মনে করেন—সংগীতের প্রতি ভালোবাসা এবং অধ্যবসায়ের কারণে শুভমিতা নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে। এভাবে সংগীতচর্চা চলমান রাখলে একদিন সে দেশের স্বনামধন্য কণ্ঠশিল্পী হবে।
নতুন কুঁড়ির আঞ্চলিক বাছাই পর্বে শুভমিতা অংশ নেয় সিলেট শিল্পকলা একাডেমিতে। সেখানে তার প্রথম পরিবেশনা বিচারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আঞ্চলিক পর্বে উত্তীর্ণ হওয়ার পর শুভমিতাকে নিয়ে তার পরিবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। প্রতিযোগিতার প্রতিটি পর্যায়ে পরিবার ও আত্মীয়-স্বজন শুভমিতাকে উৎসাহ দিয়েছে।
নতুন কুঁড়ির মঞ্চে শুভমিতার প্রতিটি পরিবেশনা হাজারো দর্শক-শ্রোতাকে মুগ্ধ করেছে। নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় শুভমিতার পরিবেশিত গানের মধ্যে ছিল—‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে…’, ‘দোলা লাগিল দখিনার বনে বনে…’, ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ…’ প্রভৃতি। তার কণ্ঠ, সুর ও গায়কি বিচারকমণ্ডলীকে মুগ্ধ করেছে।
গত ১৩ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের কাছ থেকে ট্রফি ও তিন লক্ষ টাকার চেক গ্রহণ করে ‘খ’ শাখার দেশসেরা শিশুশিল্পী শুভমিতা। পুরস্কার গ্রহণের পর শুভমিতা জানায়, ‘‘আমি বড় হয়ে একজন গুণী শিল্পী হতে চাই। দেশের সংগীতকে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাই। নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার সাফল্য আমার সংগীতজীবনে অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।’’
বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। নতুন কুঁড়ির মঞ্চ শিশুদের শৈল্পিক বিকাশের পাশাপাশি তাদের দায়িত্ববোধ, শৃঙ্খলা ও আত্মবিশ্বাসও বাড়িয়ে তোলে। ১৯৭৬ সালে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিযোগিতা ২০০৫ সালে এসে বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মোঃ মাহফুজ আলমের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় দীর্ঘ ২০ বছর পর নতুন উদ্যমে শুরু হয় নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতা। এ বছর নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতায় প্রায় ৩৯ হাজার প্রতিযোগী অংশ নেয়। ৬৪ জেলাকে ১৯টি অঞ্চলে ভাগ করে ২৪ থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আঞ্চলিক বাছাই পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। আঞ্চলিক পর্ব থেকে ‘ক’ ও ‘খ’ উভয় শাখার সকল ক্যাটাগরিতে প্রায় ১৪ হাজার প্রতিযোগী বিভাগীয় পর্যায়ে উন্নীত হয়। দেশের আট বিভাগে একযোগে এই প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিযোগিতায় মোট বিষয় ছিল ১২টি। এগুলো হলো : অভিনয়, আধুনিক গান, আবৃত্তি, উচ্চাঙ্গ নৃত্য, কৌতুক, গল্পবলা, দেশাত্মবোধক গান, নজরুলসংগীত, রবীন্দ্রসংগীত, লোকসংগীত, সাধারণ নৃত্য ও হামদ-নাত। বিভাগীয় পর্যায় শেষে শুরু হয় চূড়ান্ত পর্ব। আট বিভাগ থেকে ১ হাজার ৪০ জন প্রতিযোগী চূড়ান্ত পর্বে অংশ নেয়। চূড়ান্ত পর্বে উত্তীর্ণ ২৭৯ জন প্রতিযোগী সেরা ১০ পর্বে অংশগ্রহণ করে। এই পর্ব থেকে সেরা ৫ জন বাছাই করা হয়। এরপর ফাইনালে ‘ক’ বিভাগ থেকে ৩৬ জন এবং ‘খ’ বিভাগ থেকে ৩৭ জন প্রতিযোগীকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হয়। দীর্ঘ এই প্রক্রিয়ায় ‘খ’ বিভাগে সেরাদের সেরা অর্থাৎ চ্যাম্পিয়ন হয় শুভমিতা তালুকদার।
সদ্য সমাপ্ত নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার বাছাই প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ স্বচ্ছ ও ন্যায্যভাবে পরিচালিত হয়েছে। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের প্রতিভা যাচাইয়ের দায়িত্বে ছিলেন ২৯৩ জন বিজ্ঞ বিচারক, যাঁরা প্রতিটি পর্যায়ে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে মূল্যায়ন করেছেন। প্রতিযোগিতাটিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে এবার ব্যাপক প্রচার কার্যক্রম চালানো হয়েছে। এর ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের শিশু-কিশোররাও এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছে। ধর্ম, বর্ণ-নির্বিশেষে সকল শ্রেণির শিশু-কিশোর এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। বিটিভিতে প্রচারিত নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার প্রতিটি পর্ব বিটিভির ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেলেও প্রচার করা হয়েছে। অনেকেই পরিচিত শিশু-কিশোরদের পরিবেশনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করেছেন। এর ফলে নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতাটি নেটিজেনদের কাছে অনলাইন বিনোদন হিসেবেও বিবেচিত হয়েছে।
ব্যতিক্রম ক্ষেত্র ছাড়া প্রতিটি শিশু বিশেষ কোনো প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। শিশুদের বিশেষ প্রতিভা খুঁজে বের করাই নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতার মূল উদ্দেশ্য। নতুন কুঁড়ি প্রতিযোগিতা শুভমিতার মতো অসংখ্য প্রতিভা আবিষ্কার করেছে, যা দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনকে সমৃদ্ধ করেছে। নতুন কুঁড়ি শিশু-কিশোরদের কাছে শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয়, বরং শিল্পজীবনের প্রথম পাঠশালা। অল্প বয়সে প্রতিযোগিতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে অভিনয় করা, গানের সুর তোলা, গল্পবলা কিংবা আবৃত্তি শিশু-কিশোরদের সারাজীবনের আত্মবিশ্বাস গড়ে দেয় এবং তাদের ভবিষ্যতের পথকে আলোকিত করে।
প্রত্যন্ত গ্রামের সাধারণ পরিবেশ থেকে উঠে এসে জাতীয় মঞ্চে নিজের জায়গা করে নেওয়া শুভমিতার জন্য মোটেই সহজ ছিল না। শহরের মতো পর্যাপ্ত সাংস্কৃতিক অবকাঠামো বা প্রশিক্ষণের সুযোগ না থাকলেও তার দৃঢ় মনোযোগ, নিয়মিত অনুশীলন এবং অবিচল অধ্যবসায়ই তাকে সামনে এগিয়ে নিয়েছে। পরিবার ও শিক্ষকদের অকুণ্ঠ উৎসাহ এবং নিজের ইচ্ছাশক্তিকে পাথেয় করে সে ধাপে ধাপে তৈরি করেছে সাফল্যের পথ। গ্রামের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে জাতীয় পর্যায়ে শুভমিতার দেশসেরা হওয়া প্রমাণ করে—বাংলাদেশের যে-কোনো প্রান্তের শিশুই পরিশ্রম ও অধ্যবসায়ের মাধ্যমে বড় সাফল্য অর্জন করতে পারে। শুভমিতার এই সাফল্য দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের আরও অনেক শিশু-কিশোরকে স্বপ্ন দেখাতে অনুপ্রাণিত করবে।
লেখক : বিসিএস তথ্য ক্যাডারের সদস্য এবং জনসংযোগ কর্মকর্তা পদে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ে কর্মরত