পরাজিত ফ্যাসিবাদী মাফিয়া শক্তি যেন আর মাথাচাড়া দিতে না পারে
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার বলেছেন, পরাজিত ফ্যাসিবাদী মাফিয়া শক্তি যেন আর মাথাচাড়া দিতে না পারে। মাফিয়া তন্ত্রের ফ্যাসিবাদের পদতলে কখনো যেন আমাদের অধিকার ও জীবনকে সমর্পণ করতে না হয়, সেই লক্ষ্যে সবাইকে কাজ করতে হবে।
আজ শনিবার দুপুরে মেহেরপুরের গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সম্মেলন কক্ষে উপজেলার সমস্যা ও সম্ভাবনা শীর্ষক আয়োজিত মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন তিনি।
মেহেরপুর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) তাজওয়ার আকরাম সাকাপি ইবনে সাজ্জাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় উদ্বোধনী বক্তব্য রাখেন গাংনী উপজেলা নির্বাহী অফিসার আনোয়ার হোসেন।
এ সময় বক্তব্য রাখেন, মেহেরপুর-২ আসনের সাবেক এমপি ও সাবেক জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমজাদ হোসেন, গাংনীর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা বানী ইসরাইল, গাংনী উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি রেজাউল হক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান বাবলু, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের আহ্বায়ক সামসুল আলম সোনা, গাংনী পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক আব্দুর রাজ্জাক, গাংনী পৌর জামায়াতের রাজনৈতিক সেক্রেটারি জিল্লুর রহমান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মেহেরপুর জেলা শাখার সদস্য সচিব মোজাহিদুল ইসলাম, গাংনী টেকনিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ স্বপন, গাংনী উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি জুলফিকার আলী কানন, গাংনী বাজার কমিটির সভাপতি সালাহ উদ্দীন শাওন প্রমুখ।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি আরও বলেন, উপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়াও ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য। ২৪ এর জুলাইয়ের অভ্যুত্থানের চেতনাও ছিল মুক্তির চেতনা। অতএব, ৭১ এবং ২৪ এর অভ্যুত্থান নিয়ে আলাদা ভাবা, কোনটা ছোট কোনটা বড় এভাবে পার্থক্য করার কোনো সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের জনগণের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা। এটা কেউ চাইলেও ছোট করতে পারে না। মুক্তিযুদ্ধ না হলে আমরা এই স্বাধীন ভূখণ্ড পেতাম না। সেটা মুক্তিযুদ্ধের মহিমায় সমুজ্জ্বল হয়ে থাকবে। তাই বলে ২৪ এর চেতনার কথা আমরা বলতে পারব না? প্রশ্ন করেন তিনি।
তিনি বলেন, ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং ২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থান দুটো ঘটনাই ঘটেছে মুক্তির চেতনা নিয়ে। সুতরাং আমাদের ৭১ এবং ২৪ এর জুলাই অভ্যুত্থান দুটো ঘটনাই তুলে ধরতে হবে। মুক্তির চেতনার সাথে সংগতিপূর্ণ কাজগুলো আমাদের ধারণ করতে হবে।
মনির হায়দার বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে চার সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ২ হাজার মানুষ জীবন দিয়েছে। তাদের হত্যা করা হয়েছে। প্রায় ৩০ হাজার মানুষ অঙ্গহানির শিকার হয়েছেন, হয়েছেন গুরুতর আহত। এগুলো কি শুধুমাত্র রাজনৈতিক আন্দোলনে ঘটে? প্রশ্ন করেন তিনি। এটা রীতিমত একটা যুদ্ধাবস্থা ছিল।
তিনি বলেন, আমরা ২০২৪ সালের যে ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে এসেছি, সেটা রীতিমত একটা যুদ্ধাবস্থা ছিল। যেখানে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি পক্ষ পরাজিত হয়েছে। যেই পক্ষকে আমরা বলি মাফিয়া তান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট। সেই মাফিয়া তান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট শক্তি পরাজিত হয়েছে জনগণের কাছে। তারা এই দেশের সকল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিজেদের কব্জায় নিয়ে জনগণের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। সেই সশস্ত্র বাহিনীর বিরুদ্ধে নিরস্ত্র জনগণের প্রতিরোধ বিজয়ী হয়েছে। সেই বিজয়ের মধ্য দিয়ে আমরা আজকে এই মুক্ত পরিবেশ পেয়েছি। অধিকাংশ জনগণের জন্য যেটা মুক্ত পরিবেশ, পরাজিত শক্তির জন্য সেটা পরাধীন পরিবেশ। তাদের জন্য এটা স্বাধীন পরিবেশ নয়। জুলাই ২৪ এ তরুণ তাজা প্রাণের বিনিময়ে আমরা একটা ভয়ংকর মাফিয়া তন্ত্রের হাত থেকে এদেশকে মুক্ত করেছি।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে আমরা বাংলাদেশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চাই, যেখানে সোহহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে সকলে সহাবস্থান করবেন। যেখানে সকলের ন্যায্য অধিকার থাকবে, কেউ বঞ্চিত হবেন না। এই তত্ত্বে এবং এই কর্মে বিশ্বাসী।
তিনি বলেন, এই বাংলাদেশে গত ১৬ বছরে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অধিকার জিম্মি হয়ে পড়েছিল। আমরা যতটুকু অধিকার পেতাম, যতটুকু দয়া করে দেওয়া হতো। আমার যতটুকু অধিকার, সেটা আমার মতো আরেকজন নির্ধারণ করে দিতো। এই পদ্ধতিতে গোটা দেশের মানুষ জিম্মি দশায় পতিত ছিল। আমরা যেটাকে বলি ফ্যাসিবাদ ও মাফিয়া তান্ত্রিক শাসন। এমন এক শাসকগোষ্ঠী আমাদের বুকের উপর চেপে বসেছিল, যারা শুধু আমাদের অধিকারগুলোই কেড়ে নেয়নি, আমাদের নানা রকম নিপীড়ন-নির্যাতনের নিস্পেষণের দিকে ঠেলে দিয়েছিল। আমরা নিজেদের নিয়মিত নাগরিক ভাবতে ভুলে যাচ্ছিলাম। সেই মাফিয়া চক্র এমন এক পদ্ধতি প্রবর্তন করেছিল, তারা পাঁচ বছর পর পর ভুয়া নির্বাচনী খেলা দেখিয়ে জনগণকে ঘোষণা করতো আমরা নির্বাচনে জয়লাভ করেছি, আগামী পাঁচ বছর আমরা ক্ষমতায় থাকবো, আমাদের আর কেউ কিছু বলতে পারবে না। আমরাও প্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। চেষ্টা ছিল, আকাঙ্ক্ষাও ছিল, কিন্তু এক পর্যায়ে ভাবতাম মনে হতো বোধহয় এই অবস্থার আর পরিবর্তন হবে না। প্রচণ্ড হতাশাজনক, এক অন্ধকারময় জীবন গোটা দেশ জুড়ে সবার জন্য নেমে এসেছিল।
তিনি বলেন, প্রশাসনে যারা আছেন, তারা পেশাদারিত্ব ও নিরপেক্ষতা নিয়ে কাজ করছেন তাদের ব্যাপারে আমাদের কোনো প্রশ্ন নেই, কোনো বিতর্ক নেই। কিন্তু একটি পক্ষ এতদিন খেয়ে পরে মোটা-তাজা হয়ে মাঠে নামবে আর অপর পক্ষটি এতোদিন না খেয়ে নির্যাতিত নিপীড়িত হয়ে মাঠে নামবে তাদের মাঝে নিরপেক্ষতা দেখাবেন এই নিরপেক্ষতা এখন প্রযোজ্য হবে না।
তিনি প্রশাসনের উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যারা ২৪ এর গণহত্যার সাথে জড়িত ছিল, গণহত্যাকে নানাভাবে মদদ দিয়েছে, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছে তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করাটাই নিরপেক্ষতা। তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে নিরপেক্ষতা দেখানো মানে আত্মঘাতী। এটা এক সময় আপনার জন্যও বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে। সুতরাং যেকোনো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষের ভবিষ্যৎ, গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রযন্ত্রকে নিরাপদ করার জন্য, প্রশাসনের কর্মকর্তাদের কাজের নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য এই গুরুতর অপরাধের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যারা জড়িত ছিল, তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা আমাদের সকলের দায়িত্ব।
তিনি বলেন, পরাজিত শক্তির অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক এখনো পুরোদমে সক্রিয়। অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক মানে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন ধরণের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আছে। তাদের এখনো বিভিন্ন ধরণের ব্যবসা-বাণিজ্য, ডিলারশিপ রয়েছে। এগুলো পরাজিত ফ্যাসিবাদীদের হাতে থাকবে আর আপনি মনে করবেন সমাজে নিরপেক্ষতা থাকবে এটা হবে না। আপনি যদি মনে করেন, পরাজিত ফ্যাসিবাদ আছে, আমরা নিরপেক্ষ আচরণ করবো এটা আপনার জন্য আত্মঘাতী হবে।
তিনি বলেন, জনগণের সহায়তায় প্রশাসন এমন ব্যবস্থা নেবেন যাতে, পরাজিত অপরাধী চক্রের অর্থনৈতিক অপরাধচক্র ভেঙে পড়বে। এরপর সেখানে নিরপেক্ষতার চর্চা হবে। সেখানে স্বাভাবিক আইনের চর্চা হবে। এর আগে প্রশাসন কোনো নিরপেক্ষতা দেখাতে গেলে জনগণ এবং প্রশাসনের জন্য বুমেরাং হবে।
মুজিবনগর প্রসঙ্গে মনির হায়দার বলেন, জায়গাটার পূর্ব নাম বৈদ্যনাথতলা ভবেরপাড়া। বৈদ্যনাথতলা ভবেরপাড়া এই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্মের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সেখানে বিপ্লবী সরকার শপথ গ্রহণ করেন। ‘ডিক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স’ সেখান থেকেই প্রকাশিত হয়, যেটা এখন সংবিধানে যুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক সুবিচার ছিল মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা। ‘ডিক্লারেশন অফ ইন্ডিপেন্ডেন্স’ মুজিবনগর থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, ৭২ সালের সংবিধানে এই মূলনীতিগুলো যুক্ত করা হয়নি।
জুলাই অভ্যুত্থানের পর বর্তমান সংস্কার কমিশন, বর্তমান রাষ্ট্র সংস্কারের উদ্যোগে এই মুক্তিযুদ্ধের তিনটি ঘোষণাকে সংবিধানে সংযুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, যে বৈদ্যনাথতলায় এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি ঘটেছিল, যেখানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই জায়গাটির নাম মুজিবনগর হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি সংগ্রামের স্বাধিকার আন্দোলনে শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অস্বীকার বা উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই।
কিন্তু যেখানে শেখ মুজিব কোনোদিন আসেননি, তার সাথে মুজিবনগরের কোনো সম্পর্ক নেই তার নামে মুজিবনগর কেন হবে? প্রশ্ন করেন তিনি। তিনি বলেন, এই জায়গাটির নাম মুক্তিনগর, মুক্তিপুর বা অন্য কোনো নাম দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, প্রশাসন এবং আমাদের সকলের উচিত জুলাই অভ্যুত্থানের নায়কদের চেহারা মনে রাখা। তাহলে নিরপেক্ষতার মানদণ্ডটা বুঝতে সহজ হবে। জীবন হাতে নিয়ে, নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও যারা বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছে সেই জুলাই যোদ্ধাদের কথা মনে হলে নিরপেক্ষতার মানদণ্ড সম্পর্কে বোঝা যাবে।