তীব্র কষ্ট, হতাশা ও বিভিন্ন ধরনের ক্ষতির সম্মিলিত অভিজ্ঞতা এবং জেনেটিক, মনস্তাত্তিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণসহ অন্যান্য নেতিবাচক উপাদানের সম্মিলিত ফল আত্মহত্যা।
যখন কোনো ব্যক্তি তার বিবেক, বুদ্ধিমত্তা বা বিচার বিবেচনা হারিয়ে ফেলে তখন সে নিজেকে হত্যা করে। নিজেকে হত্যা করাই আত্মহত্যা। আত্মহত্যা এক অর্থে আত্ম খুন-নিজেকে নিজে খুন করা। আত্মহত্যা বলতে এমন এক ধরনের মৃত্যুকে বুঝায়, যেখানে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় বা নিজের হাতে নিজের জীবন সংহার করে। এটা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ হতে পারে। কোনো ব্যক্তি স্বেচ্ছায় আত্মহত্যা করে না বরং বিভিন্ন সামাজিক ঘটনা ব্যক্তির আত্মহত্যা করার প্রবণতাকে প্রভাবিত করে।
প্রতিটি মানুষই জীবনের কোনো না কোনো সময়ে আফসোস করে আমাদের জীবন কেন এত ক্ষণস্থায়ী? এত সুন্দর পৃথিবী, এত সুন্দর জীবন আর জীবনের সাথে সম্পর্কের এত মধুর বন্ধন ছেড়ে কে এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করতে চায়? এ প্রশ্নের উত্তর, ‘না’।
প্রিয়জনকে ছেড়ে কেউই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে চায় না। পৃথিবীতে এমন একজনও সুস্থ মানুষ পাওয়া যাবে না যে কি না মৃত্যুর কথা মনে করলে আঁতকে ওঠে না। তবু কিসের আশায় মানুষ নিজের জীবনকে নিজেই হত্যা করছে? এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গেলেই সামনে চলে আসে আত্মহত্যার করুণ রূপ!
বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট জেলা মেহেরপুর। আয়তনে ক্ষুদ্র হলেও, আত্মহত্যার মতো এক ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে রুপান্তরিত হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে জেলা পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের নেই কোনো সরকারি পরিসংখ্যান। কিন্তু মেহেরপুরের তিনটি থানা ও তিনটি সরকারি হাসপাতালে তথ্য ভয়াবহ।
সংবাদ মাধ্যমের তথ্যমতে ২০২৪ সালে জেলার তিনটি থানায় নথিভুক্ত হয়েছে ১১৯টি অপমৃত্যুর ঘটনা। এর মধ্যে ৫৯ জন গলায় ফাঁস দিয়ে এবং ২৯ জন বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। বাকিরা ঘুমের ওষুধ, উঁচু স্থান থেকে লাফিয়ে পড়া বা অন্যান্য পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন।চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত অপমৃত্যুর সংখ্যা পৌঁছেছে ৪৬-এ। এর মধ্যে ২২ জন আত্মহননের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছেন ফাঁস, ১৭ জন বিষপান করেছেন, বাকিরা অন্যভাবে মৃত্যুর দিকে এগিয়েছেন।
তবে যে চিত্রটি সবচেয়ে গভীর দুশ্চিন্তা তৈরি করে, সেটি হলো আত্মহত্যার চেষ্টাকারীদের সংখ্যা। মেহেরপুরের তিনটি সরকারি হাসপাতালে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত সময়ে মেহেরপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ২২৭, মুজিবনগর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৪৫ এবং গান্ধীর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৮৯ জন, মোট ৩৬১ জন নারী, পুরুষ ও শিশুকে পাকস্থলী পরিষ্কারের জন্য ভর্তি করা হয়েছে। যারা কেউ ঘুমের ওষুধ, কেউ বিষ বা কীটনাশক খেয়েছেন আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে।চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন অন্তত ৪০ জন। অর্থাৎ, গড়ে প্রতি ১২ ঘণ্টায় একজন মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন এই জেলায়।
জেলা তথ্য অফিস দাবি করছে, তারা গত পাঁচ মাসে ৩২টি সচেতনতামূলক সভা ও ১৬টি নারী সমাবেশ করেছে।
মেহেরপুর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কেন্দ্রের তথ্যমতে প্রায় তিদিনই আত্মহত্যার চেষ্টাকারী রোগী আসেন। কেউ বিষ পান করে, কেউ ঘুমের ওষুধ। বাঁচলেও তারা বাকি জীবন জটিল রোগে ভোগেন। কখনো কিডনি নষ্ট হয়, কখনো পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যান।
আত্মহত্যা যে কত নির্মম, আত্মহত্যা যে কত নিষ্ঠুর-তা কেবল প্রিয়জন হারা মানুষগুলো বুঝতে পারে। মৃত্যুর ওপারের জীবন কেমন আমাদের জানার সুযোগ নেই। তাই হয়তো বেঁচে থাকার এপারের জীবনে মানুষ এমন কিছু ঘটনার সম্মুখীন হয় যে ঘটনায় তার জীবন হয়ে ওঠে অতি তুচ্ছ যা হননে একজন মানুষ জীবনের মহত্ত্ব একটি মুহূর্তের জন্য ভুলে যায়। এই নিষ্ঠুর ঘটনা হতে পারে একটি ঘটনা অথবা কয়েকটি ঘটনার সমন্বয় যা রূপ নেয় ভয়ংকর বিষণ্নতায় মোড়া এক অলীক পরিণতির।
আত্মহত্যা নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন, অনেক ভুল ব্যাখ্যা, ভয় এবং কুসংস্কার কাজ করে। প্রতিটি আত্মহত্যার পেছনে যিনি আত্মহত্যা করেন, তার নিজস্ব কিছু কারণ থাকে। প্রতিটি মানুষ আলাদা, আবেগ-অনুভূতিও আলাদা। আমি যেভাবে পৃথিবীকে দেখি, আরেকজন সেই দৃষ্টিতে পৃথিবী দেখবে না। তাই কেউ কেন সুইসাইড করল, এটা চট করে বলা খুব কঠিন। ডাক্তাররা কারণ বের করার চেষ্টা করেন, কিন্তু একজন মানুষের মনের মধ্যে ঠিক কী ঘুরছে এটা বোঝা কঠিন। কেন সে এই সময়ে আত্মহত্যা করলো এটা জানাও প্রায় অসম্ভব।
অধিকাংশ মানুষ বুঝেই না বিভিন্ন পরিস্থিতির কারণে কেন লোকে বিষণ্ণ হয়ে পড়ে।তারা জানে না সিচুয়েশনাল অথবা ক্লিনিক্যাল ডিপ্রেশনের কথা।তারা এটাও জানে না বাইপোলার, সিজোফ্রেনিয়া ও বর্ডারলাইন ডিজিজ কী?আত্মহনন থেকে বেঁচে ফেরা অনেক রোগী ডাক্তারকে বলেছেন যে, তারা যখন আত্মহত্যা করবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তারা তাদের প্রিয়জনদের কথা ভাবেনি। কারণ তখন তাদের কাছে নিজেদের ব্যথাটাই খুব বেশি ছিল। মনে হতেই পারে এটা খুব স্বার্থপরের মতো আচরণ। মানুষ আত্মহত্যা করে শুধু নিজে পালিয়ে বাঁচার জন্য, অন্য কারো জন্য মরে যাওয়াটা সুইসাইড নয়।সে আসলে নিজে বাঁচার উপায় হিসেবেই মৃত্যুকে বেছে নেয়।তবে হ্যাঁ,একেকজনের কারণটা থাকে একেক রকম।
আত্মহত্যার কারণ যদি বিশ্লেষণ করি তবে, শিশুকালে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, সংসারের দ্বন্দ্ব এবং যুদ্ধের স্মৃতি মানুষের ওপর ভীতিজনিত চাপ তৈরি করে, যা আত্মহত্যার কারণ হতে পারে, এমনকি অনেকদিন পরে হলেও হতে পারে। মাদক ও মদ্যপান মানুষের সুইসাইডের আশংকা বাড়িয়ে তোলে। এ ছাড়া, সম্পর্ক ভেঙে গেলে, চাকরি হারালে, আয়ের পথ না পেলে, সামাজিক পজিশন হারালে,লজ্জা পেলে, বুলিং ও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হলে, আটক হলে মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারে। ক্রমাগত অসুস্থতাও আত্মহত্যার কারণ, তবে কম।বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার, বাবা-মায়ের মধ্যে সুসম্পর্কের ঘাটতি, পারিবারিক দ্বন্দ্ব, পরকীয়া, প্রেমে ব্যর্থ হওয়া, দীর্ঘদিনের দরিদ্রতা,ঋণগ্রস্ত, প্রতারণার শিকার হওয়া,শত্রুর কাছে ধরা না দেওয়া,ব্যবসায় বড় ধরনের ক্ষতি, প্রিয়জনের মৃত্যু, পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না পাওয়া, সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের অবহেলা, নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, পারিবারিক, ধর্মীয় ও সামাজিক দায়িত্ববোধের অভাব, সাইবার ক্রাইমের শিকার হওয়া, ইভটিজিং, মানসিক অসুস্থতা,হতাশা ও অসহায়ত্ব বোধ থেকে কিশোর-কিশোরীরা অনেক সময় এই পথে পা বাড়ায়।যেসব মানুষ তাদের জীবনে এ ধরনের জটিল সমন্বিত সমস্যার মুখোমুখি হন, তাদের আচরণের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটে আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে। আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা ও মানসিক অসুস্থতা ইত্যাদি কারণে বেশির ভাগ আত্মহত্যার ঘটনাগুলো ঘটে থাকে।
যখন কারও জ্ঞান-বুদ্ধি, বিবেক ও উপলব্ধি-অনুধাবন শক্তি লোপ পায়, নিজেকে অসহায়-ভরসাহীন মনে হয়, তখনই ধর্ম-কর্ম ভুলে মানুষ আত্মহত্যা করে বসে। যে ব্যক্তি আত্মহত্যা করে, সে শুধু তার নিজের ওপরই জুলুম করে না বরং এতে মা-বাবা, ভাইবোনসহ আত্মীয়-পরিজন সবাই খুব কষ্ট পায় এবং অত্যন্ত বিচলিতবোধ করে।পরিবারের একজন সদস্যের মৃত্যু তার পরিবারের উপর ভয়াবহ প্রভাব রাখে। কারণ মানুষটির এই না বলে চলে যাওয়াটা, সেই মানুষটির একার বিষয় নয়। মৃত মানুষের পরিবার-পরিজন সারাজীবন একটা উত্তরবিহীন প্রশ্ন, অতৃপ্ত মন এবং গভীর শূন্যতা নিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দেয়।’
বিশ্বখ্যাত মনোবিশ্লেষক সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মতে, মানুষের অবচেতনেই থাকে ‘মৃত্যুপ্রবৃত্তি’। পরিবেশ–পরিস্থিতির প্রভাবে এই মৃত্যুপ্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে, আর তখনই হয় তার ‘মরিবার সাধ’। গবেষণায় দেখা যায়, মানবমস্তিষ্কের সেরিব্রোস্পাইনাল তরলের মধ্যে ‘৫-হাইড্রোক্সি ইনডোল অ্যাসেটিক অ্যাসিড’ নামের একটি রাসায়নিক পদার্থের পরিমাণ কমে গেলে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়ে যায়। প্রথমে বিক্ষিপ্তভাবে মনের মধ্যে আত্মহত্যার চিন্তা আসে। এই চিন্তাগুলো পরে বারবার আসতে থাকে। ব্যক্তি এ চিন্তা থেকে সহজে মুক্ত হতে পারে না। আত্মহত্যার চিন্তা তার স্বাভাবিক কাজকর্মের ওপর প্রভাব ফেলে। তীব্র থেকে তীব্রতর হয় তার আত্মহননের ইচ্ছা। সে ভাবে, ‘কেন আমি বেঁচে থাকব?’ সে জীবনের ইতি টানার চিন্তা করে। একসময় তার মনে হয়, তার মরে যাওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। কখনো আবেগতাড়িত হয়ে, আবার কখনো পরিকল্পনা করে সে মৃত্যুচেষ্টা করে। সফল না হলে আবার তার মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে আত্মহত্যার চিন্তা আসতে থাকে। এ চিন্তার চক্র থেকে সে বের হতে পারে না। এটি তার মধ্যে ফিরে ফিরে আসতে থাকে। তাই যে ব্যক্তি কথাচ্ছলেও মৃত্যুইচ্ছা ব্যক্ত করে, ধরে নিতে হবে তার মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে।আবার পরিবারে যদি আত্মহত্যা বা এর চেষ্টার ইতিহাস থাকে, তবে পরিবারের অন্য সদস্যদেরও আত্মহত্যার ঝুঁকি বেড়ে যায়। মাদক গ্রহণ, যৌন নিপীড়নের শিকার, বয়ঃসন্ধিকালে দেহ ও মনের পরিবর্তনগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে না পারা, আবেগ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, ঝামেলাযুক্ত পরিবার আর নিজের যৌন–পরিচিতি নিয়ে সন্দিহান থাকা কিশোর আর তরুণদের মধ্যেও আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে।
আত্মহত্যার জন্য মিডিয়াও কোন অংশে কম দামী নয়।যে ভাষায় মিডিয়ায় আত্মহত্যার খবর দেই, কিংবা যে ভাষায় আত্মহত্যা নিয়ে আলোচনা করে, আত্মহত্যাকে আমাদের সাহিত্যে, শিল্পে, সিনেমায় যেভাবে দেখানোর চেষ্টা করে, সেটার দিকে কি আমরা কখনও ন্যূনতম মনোযোগ দিয়েছি? আমরা হয়তো খেয়ালই করি না মিডিয়ার প্রতিটা সংবাদে, কিংবা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় আত্মহত্যাকে এক ধরনের যৌক্তিকতা অজান্তেই দিয়ে দেই।
আত্মহত্যার সংবাদ মিডিয়ায় যত বেশি আসে এবং সেটা যদি অসংবেদনশীল ভাষায় লিখা হয় এবং আমরা যদি সেটাকে ভুলভাবে আলোচনা করি, তাহলে সেটা আরও বহু মানুষকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে। বিশেষ করে একই রকম পরিস্থিতিতে পড়া একই মানুষ একইভাবে আত্মহত্যা (কপিক্যাট সুইসাইড) করার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়।
একটা বদ্ধ জায়গায় চারকোল পুড়িয়ে তারপর সেখানে কার্বন মনোক্সাইড পয়জনিংয়ের মাধ্যমে আত্মহত্যার একটা চর্চা শুরু হয়েছিল তাইওয়ানে। এই আত্মহত্যার খবরগুলো যখন পত্রিকায় বিস্তারিত আসতে শুরু করলো তখন দেখা গেলো সে দেশে আত্মহত্যার সংখ্যা তো বেড়েছেই, সঙ্গে বহু আত্মহত্যাকারী ব্যবহার করছিলেন চারকোলের ওই পদ্ধতি। পরে একই প্রবণতা ছড়িয়ে পড়ে হংকং, চীন ও জাপানেও।
সাম্প্রতিককালে আমরা দেখবো একই রকম ঘটনার প্রবণতা আমাদের দেশেও দেখা যাচ্ছে। কোনও কাঙ্ক্ষিত মানুষকে ফোনে অথবা ভিডিও কলে রেখে আত্মহত্যার খবর আমরা খুব বিস্তারিত (অনেক ক্ষেত্রে ছবিসহ) প্রকাশ করছি। এ ধরনের ঘটনা এখন বাড়ার প্রবণতা দেখা
সমাজবিজ্ঞানী ও নৃতত্ত্ববিদরা মনে করেন আত্মহত্যা একটি সামাজিক বিষয় বা ফেনোমেনা। প্রতিটি আত্মহত্যার ঘটনা সেদেশেরই সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং মানুষের মনো-সামাজিক অবস্থার প্রতিচ্ছবি। রাজশাহীর আত্মহত্যার তালিকায় যারা আছেন, তাদের মধ্যে সবচাইতে আলোচিত হচ্ছে পয়লা বৈশাখের দিন নন্দনগাছি স্টেশনে ষাটোর্ধ্ব রুহুল আমিনের আত্মহত্যার ঘটনা। তিনি খুব ঠান্ডা মাথায় ট্রেনের নিচে শুয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেন। সেই ভিডিও ভাইরাল হয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।প্রথমে ভিন্ন কারণের কথা জানা গেলেও পরে পরিবার থেকে জানানো হয়, ঋণের বোঝা বইতে না পেরে তার এমন সিদ্ধান্ত। পিঁয়াজ চাষের জন্য তিনি ঋণ নিয়েছিলেন। দেশের বিভিন্ন এনজিও, মহাজন ও কিছু ব্যাংক এভাবেই কায়দা করে মানুষকে ঋণ দেয়। এবং একসময় ঋণভারে জর্জরিত করে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে।
সম্প্রতি আলোচিত ঘটনা মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছেন র্যাব কর্মকর্তা এ এস পি পলাশ সাহা। মরদেহের পাশেই পড়ে ছিল একটি চিরকুট। সেখানে লিখে তিনি নিজের মৃত্যুর দায় নিয়েছেন। সামাজিক মাধ্যমে বিষয়টি ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই বলছেন পলাশ সাহা আসলে জীবন থেকে পালিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন। সংক্ষিপ্ত চিরকুটটিতে পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ্যে যা লিখেছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে তিনি মূলত পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে এই কাজ করেছেন।
এই কষ্ট বয়ে বেড়াতে বেড়াতে ব্যক্তি এতোটাই ক্লান্ত হয়ে পড়েন যে, একসময় নিজেই সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এটা নিজেকে একধরনের শাস্তি দেয়া। সেই সাথে মৃত ব্যক্তি হয়তো মনেকরেন দ্বন্দ্বের সাথে জড়িত চরিত্রগুলো যদি একটুও শিক্ষা পায়। এই আত্মহত্যার মাধ্যমে পলাশ সাহা পরিবারের প্রতি তার ক্রোধ প্রকাশ করেছেন।
একজন মানুষ ঠিক কী কারণে জীবন থেকে পালিয়ে যেতে চান, এটা নিয়ে নির্দিষ্ট কোনো উপসংহারে পৌঁছানো কঠিন। বিশিষ্ট রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী সাদি মহম্মদ তকিউল্লাহ ৬৬ বছর বয়সে যখন স্বেচ্ছামৃত্যুকে বেছে নিয়েছিলেন, সমাজের কাছে তা এক দারুণ বিষাদময় ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আত্মহত্যা নিয়ে মানুষের মনে অনেক প্রশ্ন, ভুল ব্যাখ্যা, ভয় এবং কুসংস্কার কাজ করে। সাদি মহম্মদের আত্মহনন নিয়েও বিভিন্ন আলোচনা হয়েছে।এই বয়সে তিনি কেন চলে গেলেন? এরজন্য দায়ী কি তাঁর একাকিত্ব, অতীতের ট্রমা, মায়ের উপর নির্ভরতা, বন্ধু-স্বজনদের পাশে না থাকা ইত্যাদি।
মেহেরপুর সদরের পুতুল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পারিবারিক চাপ, সমাজের প্রত্যাশা, কর্মজীবনের অনিশ্চয়তা ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা শিক্ষার্থীদের মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত হতাশাগ্রস্ত হয়ে আত্মহত্যা করেছেন।
পুতুলের মানসিক চাপের একটি বড় অংশ আসে পারিবারিক ও সামাজিক প্রত্যাশা থেকে। বিশেষ করে বাংলাদেশে পরিবার ও সমাজ শিক্ষার্থীদের ওপর উচ্চ প্রত্যাশা আরোপ করে। তাঁদের অনেক সময় এই চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে, বিশেষত যদি তাঁরা একাধিক ক্ষেত্রে ব্যর্থতার সম্মুখীন হন। এ ধরনের চাপ শিক্ষার্থীদের মানসিক স্থিতিশীলতা নষ্ট করে এবং তাঁরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
পরিশেষে, সময় বদলে গেছে। তার সাথে পাল্টে গেছে আমাদের জীবন ধারা। তাই আমাদের আরও ভাবতে হবে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে। ইন্টারনেট আসক্তি, সমাজের অরাজকতা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, চাকরিজীবী অভিভাবকের সন্তানের জন্য সময় কম দেওয়া, প্রিয়জনের সাথে দূরত্ব বেড়ে যাওয়া, ফেসবুকের বিমূর্ত বন্ধুর মাঝে বুদ হয়ে থেকে সামনের বন্ধুকে ভুলে যাওয়া, ভিডিও গেমসের জগতে গিয়ে বিকেলে মাঠের ফুটবলের চল হারিয়ে যাওয়ার মতো কারণগুলোকে নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের।জীবনে আঘাত, দুঃখ, বেদনা, কষ্ট আসে জীবনকে শক্ত করার জন্য; মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্য নয়। মনে রাখতে হবে, মৃত্যু আমাদের জীবনের লক্ষ্য নয়, বেঁচে থাকাটাই আমাদের জীবনের লক্ষ্য। আমরা চাই, মানুষ নিজেকে ভালবেসে বেঁচে থাকুক, আত্মহত্যার এই দুঃখগাঁথার ইতি ঘটুক।