
এক সময় সন্ধ্যা হলেই শোনা যেত নূপুরের শব্দ। আবৃত্তিকার গলা চেতিয়ে শোনাতেন বিদ্রোহী কবিতা। শিল্পীর মধুর গানে বুঁদ হয়ে অন্য জগতে হারিয়ে যেতেন দর্শক। নাট্যকারের ব্যস্ততা ছিল মঞ্চ কাঁপানো সব ঝাঁঝালো অভিনয়ে।
সে সব এখন যেন অতীত। এখন বাজে না নূপুর, হয় না গান, আবৃত্তিকারও খুঁজে পাওয়া যায় না আবেগ আর নাট্যকার, সে তো কবেই হারিয়ে গেছেন। দর্শকদের আনাগোনা ও করতালিতে আর গমগম করে না অডিটোরিয়াম। গ্রীনরুমটাও কাটাচ্ছে নিঃসঙ্গ সময়। ধ্বংসস্তূপের মাঝে পড়ে আছে আধভাঙা মঞ্চ, চেয়ার ও আসবাবপত্রসহ সবকিছু।
এরপর থেকে সেখানে সব কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়েছে। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের ঘটনার রেশ শুধু আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ওপরই পড়েনি, পড়েছে শিল্প ও শিল্পাঙ্গনেও। বলছিলাম ঝিনাইদহ জেলা শিল্পকলা একাডেমির কথা।
জানা যায়, ১৯৯৪ সালের ৫ জুন জেলা শহরের পুরোনো জেলখানা এলাকায় ৪৫০ আসনবিশিষ্ট অডিটোরিয়ামসহ শিল্পকলা একাডেমি ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। ভবন নির্মাণের পর ২০০৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর শিল্পকলা একাডেমির উদ্বোধন করেন ঝিনাইদহ-২ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য ও বিএনপি নেতা প্রয়াত মসিউর রহমান। ধীরে ধীরে শিল্পকলা একাডেমি এ এলাকার শিল্প ও সাহিত্যচর্চার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়।
লালন-পাগলাকানাইয়ের পূণ্যভূমি এ জেলার ২০ লাখ মানুষের শিল্প-সংস্কৃতির ভরসাস্থল এই শিল্পকলা একাডেমি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শিল্পকলা ভবনটি বেহাল অবস্থায় পড়ে আছে। ধ্বংসস্তূপের মাঝে পড়ে আছে আধভাঙা মঞ্চ, চেয়ার, আসবাবপত্রসহ সবকিছুই। দেওয়ালজুড়ে ক্ষতের দাগ, পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়া চেয়ারগুলো এখন নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
জানা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট দুপুরে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে দফায় দফায় হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ জনতা। অডিটোরিয়ামের ভেতরে ঢুকে চেয়ার, এসি, পর্দাসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ভেঙে চুরমার করা হয় কোটি টাকার সাউন্ড সিস্টেম। ফ্যানগুলোও ভেঙে ফেলা হয়। লুটে নেওয়া হয় সিসিটিভিসহ মূল্যবান যন্ত্রপাতি।
গণশিল্পী সংস্থার জেলা শাখার সভাপতি আব্দুস সালাম বলেন, এ জেলার সাংস্কৃতিক কর্মীদের প্রাণকেন্দ্র ছিল শিল্পকলা একাডেমি। হামলা-ভাঙচুরের পর থেকে দীর্ঘ আট মাস ধরে সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়েছে। সরকারের উচিত এ বিষয়ে নজর দেওয়া। নইলে লালন-পাগলাকানাইয়ের জন্মভূমি ঝিনাইদহে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম মুখ থুবড়ে পড়বে।
জেলা সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি বীর মুক্তিযোদ্ধা লিয়াকত হোসেন বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভ থাকতেই পারে। তাই বলে দেশের অন্যতম একটি সাংস্কৃতিক অঞ্চলের শিল্পকলা একাডেমিতে হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা উচিত হয়নি। এতে এ জেলার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের এ বিষয়ে দ্রুত নজর দেওয়া প্রয়োজন।
জেলা কালচার অফিসার জসিম উদ্দিন বলেন, ওই দিনের ঘটনায় অন্তত দুই কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে শিল্পকলা একাডেমির। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে। তাদের দিকনির্দেশনার অপেক্ষায় আছি আমরা।
এবিষয়ে ঝিনাইদহের জেলা প্রশাসক আব্দুল আওয়াল বলেন, শিল্পকলা একাডেমির ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করা হয়েছে। তবে এখনো কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। বরাদ্দ পেলেই সংস্কার কাজ শুরু করা হবে।
তিনি আরও বলেন, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম যেন ব্যাহত না হয়, সেজন্য আমাদের পক্ষ থেকে বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।