
গ্রামের প্রতিটি সাধারণ মানুষ নানা ধরনের দৈনন্দিন বিরোধ ও সমস্যার সম্মুখীন হয়। সেই সমস্যা যেমন ব্যক্তিগত সম্পত্তি সংক্রান্ত বিবাদ, গবাদিপশুর ক্ষতি, চুক্তি-দলিলের সমস্যা অথবা পারিবারিক সহিংসতার মতো অভিযোগ নিষ্পত্তি সাধারণ আদালতে দীর্ঘ সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। এই সমস্যাগুলো দ্রুত ও সহজভাবে সমাধান করার উদ্দেশ্যে গ্রাম আদালত গঠিত হয়েছে। এটি এমন একটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান যা ইউনিয়নের সীমিত এলাকায় সুনির্দিষ্ট ফৌজদাবি ও দেওয়ানি মামলা নিষ্পত্তি করতে সক্ষম। এর মাধ্যমে গ্রামে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ আইনের আওতায় এসে সহজেই তাদের অধিকার আদায় করতে পারে। এই আদালতের কার্যক্রমের আইনগত ভিত্তি প্রবর্তিত হয়েছে গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ এবং পরবর্তীতে এর কার্যকারিতা আরও শক্তিশালী করতে গ্রাম আদালত সংশোধন আইন, ২০২৪ প্রণীত হয়েছে।
এই আইনের অধীনে গ্রাম আদালত দ্রুত বিচার নিশ্চিত করে, স্থানীয় বিরোধ ও সমস্যার সমাধান করে এবং সাধারণ নাগরিকদের জন্য ন্যায্য ও সমতা ভিত্তিক আইনি সেবা প্রদান করে। এতে আদালতের জটিলতা কমে আসে, সময় ও অর্থের সাশ্রয় হয়। ফলে গ্রামের মানুষ ন্যায়বিচারের জন্য সহজেই সহায়তা পেতে সক্ষম হয়।
গ্রাম আদালতের মূল কাঠামোতে একজন চেয়ারম্যান এবং উভয়পক্ষ কর্তৃক মনোনীত চারজন সদস্য অন্তর্ভুক্ত থাকে, মোট পাঁচজন। চেয়ারম্যান স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের একজন সদস্য বা নির্বাচিত ব্যক্তি হতে পারে যিনি আদালতের কার্যক্রম সমন্বয় ও পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন। আইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, যদি ফৌজদারী বা দেওয়ানী মামলায় নারীর স্বার্থ বা শিশু বিষয় জড়িত থাকে তবে আদালতের গঠনে নিশ্চিতভাবে একজন নারী সদস্যকে মনোনয়ন প্রদান করতে হবে। এটি নিশ্চিত করে যে নারী ও শিশুদের স্বার্থের প্রতি যথাযথ সংবেদনশীলতা বজায় থাকবে।
তবে কোনো কারণে সদস্য মনোনয়ন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন না হলে, আদালত নির্দিষ্ট সদস্যদের ছাড়াই কার্যক্রম বৈধভাবে চালাতে সক্ষম। অর্থাৎ, আদালতের কার্যক্রম স্থগিত হবে না, বরং স্থানীয় বিরোধ ও বিতর্ক দ্রুত সমাধানের লক্ষ্যে বিচার কার্যক্রম যথাযথভাবে চালানো সম্ভব। এই কাঠামো নিশ্চিত করে যে, গ্রাম আদালত দ্রুত, সহজ ও সমন্বিত বিচার সেবা প্রদান করতে সক্ষম এবং গ্রামের মানুষ দ্রুত তাদের আইনি অধিকার আদায়ে সহায়তা পাবে।
গ্রাম আদালত স্থানীয় বিরোধ ও বিতর্ক দ্রুত ও সহজভাবে নিষ্পত্তি করার জন্য নির্দিষ্ট ক্ষমতা রাখে। গ্রাম আদালত ফৌজদারী মামলার ক্ষেত্রে গ্রামের অল্পমূল্যের সম্পত্তি সংক্রান্ত অপরাধ ও সাধারণ বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য ক্ষমতা রাখে। এর আওতায় আসে চুরি, মারামারি, আঘাত, ভয়ভীতি প্রদর্শন, অবৈধ জনসমাবেশ এবং অন্যের সম্পত্তি ক্ষতি বা দখল সংক্রান্ত বিষয়। এছাড়া, গবাদিপশুর ক্ষতি বা চুরি সংক্রান্ত ঘটনা, যেগুলোর মূল্য সীমিত সেসব এই আদালতে বিচার করা হয়। গ্রাম আদালত অল্পমূল্যের অর্থ বা সম্পত্তি সংক্রান্ত প্রতারণা, জালিয়াতি, চুক্তিভঙ্গ এবং ক্ষতির জন্য মামলা দেখার ক্ষমতাও রাখে। এছাড়া, এসব অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা বা সহায়তা প্রদানের বিষয়ও আদালতের বিচারযোগ্যতার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।
দেওয়ানী মামলার ক্ষেত্রে, গ্রাম আদালত চুক্তি, রশিদ বা অন্যান্য দলিলের ভিত্তিতে প্রাপ্য অর্থ আদায়ের মামলা, অস্থাবর বা স্থাবর সম্পত্তি পুনরুদ্ধার বা উহার মূল্য আদায়ের মামলা এবং কৃষি শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি বা ব্যক্তিগত অধিকারভুক্তদের বকেয়া ভরণপোষণ আদায়ের মামলা পরিচালনা করতে সক্ষম। তবে আদালতের এখতিয়ার সীমিত, যা অনুযায়ী দাবিকৃত অর্থ বা সম্পত্তির মূল্য সর্বোচ্চ তিন লক্ষ টাকা পর্যন্ত হতে হবে। এই সীমাবদ্ধতা নিশ্চিত করে যে গ্রামের সাধারণ মানুষ তাদের ছোটো ও মাঝারি মামলার দ্রুত সমাধান পেতে পারবে যেখানে ফৌজদারী ও দেওয়ানী বিতর্ক সহজভাবে এবং প্রথাগত জটিলতা ছাড়াই নিষ্পত্তি করা সম্ভব হবে।
গ্রামের একজন ব্যক্তি যদি গ্রাম আদালতে মামলা দায়ের করতে চায়, তবে সে সরাসরি তার ইউনিয়ন পর্যায়ের গ্রাম আদালতে আবেদন করতে হবে। আদালত অভিযোগ বা দাবি নথিভুক্তকরণের মাধ্যমে মামলা রেজিস্ট্রেশন করবে এবং প্রয়োজনীয় বিবরণ লিপিবদ্ধ করবে। এই প্রক্রিয়ার সময় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, গ্রাম আদালতে কোনো পক্ষ আইনজীবী নিয়োগ করতে পারবে না। সকল মামলা নিজ উদ্যোগে বা প্রাথমিকভাবে বিচারকদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত হবে। এর ফলে আদালতের কার্যক্রম সহজ, দ্রুত এবং কম খরচে সম্পন্ন হয় যা সাধারণ গ্রামের মানুষের জন্য বিচারপ্রাপ্তি আরও সহজলভ্য করে তোলে।
গ্রাম আদালতে বিচার প্রক্রিয়া মূলত উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে ভোটাভুটি দ্বারা পরিচালিত হয়। চারজন সদস্যের উপস্থিতিতে যে কোনো সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে, সদস্যদের সমান ভোট হলে চেয়ারম্যান নির্ণায়ক ভোট প্রদান করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আদালতে মামলার উভয় পক্ষ সমানভাবে বিবেচনায় অংশগ্রহণ করতে পারে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে পারে। এছাড়া শিশু, মহিলা বা শারীরিকভাবে অক্ষম ব্যক্তি যদি আদালতে উপস্থিত হয়ে নিজের পক্ষে স্বাক্ষ্য প্রদান করতে অক্ষম হন তবে উক্ত ব্যক্তির পক্ষ থেকে যথাযথভাবে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি আদালতে উপস্থিত হয়ে মামলা পরিচালনা করতে পারেন। এই প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে যে, গ্রাম আদালতের বিচার সমতাপূর্ণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং স্থানীয় প্রেক্ষাপটে গ্রহণযোগ্য।
গ্রাম আদালতের সিদ্ধান্ত কার্যকরকরণ প্রক্রিয়া যথাযথ নিয়ম অনুযায়ী সম্পন্ন হয়। আদালত যে কোনো ক্ষতিপূরণ প্রদানের আদেশ, সম্পত্তি পুনরুদ্ধার বা দখল প্রত্যার্পণের নির্দেশ প্রদান করলে, উক্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যদি অর্থ প্রদান বা সম্পত্তি হস্তান্তর সম্পন্ন না হয়, তবে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে আদায়ের ব্যবস্থা করা হয়। এছাড়া, মামলার পক্ষগণ যদি মনে করেন যে গ্রাম আদালত যথাযথ বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছে তারা সংশ্লিষ্ট সহকারী জজ বা প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আপীল করতে পারেন, যেখানে পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত বাতিল বা পরিবর্তন বা গ্রাম আদালতে ফেরত পাঠানোর সুযোগ থাকে। এই প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে যে, গ্রাম আদালতের সিদ্ধান্ত কার্যকর, যথাযথ ও ন্যায়সংগত।
গ্রাম আদালতের কার্যক্রমের ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতা ও সতর্কতা মানা আবশ্যক। আদালত রাষ্ট্রীয় গোপনীয় দলিল বা অপ্রকাশিত রেকর্ড প্রদানের জন্য কোনো ব্যক্তিকে নির্দেশ দিতে পারবে না। একইভাবে, ফৌজদারী মামলার তদন্তে পুলিশ যদি যুক্ত থাকে, তারা তদন্ত বন্ধ করতে পারবে না। তবে প্রয়োজন অনুযায়ী ফৌজদারী আদালত মামলাটি গ্রাম আদালতে প্রেরণের নির্দেশ দিতে পারে। আদালতের কার্যক্রমে অনধিকার ক্রিয়াকলাপ বা অপমান প্রদর্শনের ক্ষেত্রে, অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জরিমানা আরোপ করা হয় এবং জরিমানা আদায় না হলে আদালত সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে কারাদণ্ডের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। এসব বিধান নিশ্চিত করে যে, আদালতের সিদ্ধান্ত ও কার্যক্রমের প্রতি সম্মান রক্ষা করা হয় এবং বিচার প্রক্রিয়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হয়।
গ্রাম আদালতের সুবিধা নাগরিকদের জন্য উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। এটি দ্রুত, সহজ এবং সুলভ বিচার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে, ফলে সাধারণ মানুষ কম সময় ও খরচে তাদের বিরোধ নিষ্পত্তি করতে পারে। স্থানীয় সমস্যা স্থানীয়ভাবে সমাধান হওয়ার কারণে এলাকার সামাজিক শান্তি বজায় থাকে। পাশাপাশি, আদালত নারীর এবং শিশুর স্বার্থ সংরক্ষণে বিশেষ মনোযোগ দেয়, ফলে নারী বা শিশু বিষয়ক মামলায় নারী সদস্য মনোনয়ন বাধ্যতামূলক। ফলে গ্রাম আদালত সাধারণ মানুষের জন্য ন্যায্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সহজলভ্য বিচারব্যবস্থা হিসেবে কাজ করে।
লেখক: সহকারী তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর


