
“চুপচাপ থেকে গেলে সব শব্দ হারিয়ে যায় না, কিছু শব্দ জন্ম নেয় নীরবতায়।” মুজিবনগর উপজেলার একটি ছোট শহরের সরকারি এতিমখানা। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ১১ মে মা দিবসের সপ্তাহখানেক আগের দিন। ওইদিনের তপ্ত দুপুর। রোদে পুড়ছে মাঠের মাটি, গাছের পাতাও যেন ক্লান্ত। অথচ সেই খরতাপের ভেতর, একটি ছোট্ট ছেলে রাহি মুজিবনগর আম্রকাননের ছায়ায় বসে ছিল, নিঃশব্দ, নিরুত্তাপ।
তার নাম রাহি। বয়স আট, গায়ের রঙ শ্যামলা, চোখ দুটি কেমন যেন অন্যমনস্ক, যেন বহু দূরে কোনো কিছুর প্রতীক্ষা করছে।
রাহি জন্ম থেকেই এতিম। মা-বাবার মুখ কখনো দেখেনি। তার জন্য ‘মা’ শব্দটা স্কুলের বইয়ের ছড়া মাত্র।
“মা গো মা, তুমি কোথায়?” এই লাইনটি সে খুব সাবধানে লেখে, কিন্তু মনেও কি রাখে?
এতিমখানার অন্য শিশুরা মাঝে মাঝে ‘মা’ বলে কল্পনায় ডাকে- “মা যদি থাকতো, তাহলে”- কিন্তু রাহি কখনো এই খেলা খেলেনি। সে চুপ করে থাকে, যেন ‘মা’ শব্দটা তার কানে গিয়েই হারিয়ে যায়।
মা দিবস আসছে। শহরের স্কুলগুলোয় শিশুদের মায়েদের জন্য চিঠি লেখা, ছবি আঁকা, কার্ড বানানোর প্রতিযোগিতা চলছে। এতিমখানাতেও সরকারি চিঠি এসেছে- “মা দিবস উপলক্ষে শিশুদের মধ্যে ছবি ও কবিতা পাঠানোর আয়োজন”।
শিক্ষিকা আপা বললেন,- “তোমরাও লিখবে, আঁকবে। মা না থাকলেও মা কেমন হলে ভালো লাগতো- এটা ভাবো।”
সবাই নিজ নিজ বাড়ি থেকে লিখে নিয়ে এসেছে। কেউ লিখেছে মায়ের হাতের রান্না, কেউ ি বকাবকি, কেউ মায়ের আঁচল, কেউ বা লিখেছে সৎ মায়ের যন্ত্রণার কথা…
রাহি এক কোণে বসে আছে। সে কিছুই লেখেনি। লেখার খাতাটা ফাঁকাই রেখে দেয়। লিখতে গিয়ে কলমের কালিও শুকিয়ে যায়, সে এক লাইনও লেখেনি।
পরদিন সকাল। মা দিবস।
এতিমখানার গেটে একজন মহিলা এসে দাঁড়ালেন। নাম সায়মা। পরনে হালকা সাদা শাড়ি, চোখে ক্লান্তি, হাতে একটা চিঠি। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি।
তিনি বললেন- “আমি… একজন শিশুকে খুঁজছি। যার নাম রাহি। সবার চোখ বড় বড় হয়ে গেল।
শিক্ষিকা জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কে তার? ”সায়মা ধীরে বললেন- “হয়তো কিছুই না। কিন্তু আমি চাই, আজ তাকে ‘মা দিবস’ উপলক্ষে একটি কার্ড দিই। তার যদি ইচ্ছে হয়, আমাকে একবার ‘মা’ বলে ডাকতে পারে।”
কথাটা শুনে কারো মুখে কোনো শব্দ এলো না।
রাহিকে ডাকা হলো। ছেলেটা এগিয়ে আসলো চুপচাপ। সায়মা মৃদু হেসে তার হাতে একটি কার্ড দিলেন। কার্ডে লেখা:
“যদি কখনো মা ডাকতে ইচ্ছে করে, আমি দাঁড়িয়ে থাকব গেটে। আমি জানি, তুমি হয়তো আমার না, কিন্তু আমি তো তোমার হতেই পারি।”
রাহির চোখে জল এল না। সে কার্ডটা দেখে বলল না কিছু। শুধু একটু তাকিয়ে রইল মহিলার দিকে। তারপর আস্তে করে বলল এক শব্দ-
“মা”
একটি মাত্র শব্দ। এতিমখানার সেই সকাল এক মুহূর্তে যেন থমকে গেল। সায়মা ছেলেটিকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় তখন রাহির জন্য সেই বুকটাই।
মা দিবস মানে শুধুই ফুল বা কার্ড নয়। মা দিবস এমন এক অনুভূতির নাম, যা জন্মসূত্রে না হলেও ভালোবাসা দিয়ে গড়া যায়। ‘মা’ এই শব্দটির কোনো সংজ্ঞা নেই। কখনো তিনি গর্ভধারিণী, কখনো আশ্রয়দাত্রী, কখনো কেবল একটি অচেনা হাত, যেটা আপন করে নেয় নিঃশর্তে।
এই গল্পটি সেইসব মায়েদের জন্য- যারা সন্তান জন্ম না দিয়েও ‘মা’ হয়ে উঠেন। আর তাদের জন্যও, যারা কখনো কাউকে ‘মা’ বলে ডাকেনি, কিন্তু একদিন ডেকেছে ভয় পেরিয়ে, বুকের গভীর থেকে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক