সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভূবনে মেহেরপুরের রয়েছে সুদীর্ঘ ও গৌরবোজ্জ্বল এক ঐতিহ্য। এ অঞ্চলের মাটি যেমন রাজনৈতিক আন্দোলনে রেখেছে সাহসিকতার ছাপ, তেমনি কাব্যচর্চার ইতিহাসেও রেখেছে এক অনন্য পরিচিতি। এরই ধারাবাহিকতায় আমরা আজকের আলোচনায় মেহেরপুরের দু‘জন পুরোধা কবির কথা আলোচনা করবো। তারা হলেন মধ্যযুগের সাহিত্যের অনতম কবি কৃষ্ণহরি দাস ও নদীয়ার রাজা গিরিশচন্দ্রের সভাকবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী (১১৯৮ বঙ্গাব্দ – ১২৫১ বঙ্গাব্দ)। তারা তাদের কাব্যচর্চার মাধ্যমে মেহেরপুরকে সম্মানিত করেছেন। কবি কৃষ্ণহরি দাস মেহেরপুরকে আলোকিত করে যখন লেখেন ‘কৃষ্ণহরি দাস ভনে বাস মেহেরপুর’, তখন আমাদের গর্বে বুকটা ভরে যায়। অপর দিকে মেহেরপুরের বাড়ীবাঁকা গ্রামের সন্তান কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী যখন নদীয়ার রাজার সভাসদে মুখে মুখে কবিতা রচনা করে সবাইকে তাঁক লাগিয়ে দেন, তখন আমাদের আনন্দে মনটা নেচে উঠে। বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত এই ধারায় এই দুই প্রাজ্ঞ কবির অবদান মেহেরপুরকে করেছে গর্বিত ও শ্রদ্ধাভাজন।
কৃষ্ণহরি দাস বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগের শেষার্দ্ধের কবি ও গীতিকার। তিনি নদীয়ার বনগাঁও জন্ম নিলেও মেহেরপুরে বসবাস করতেন এবং মেহেরপুরে বসে কাব্য চর্চা করে গেছেন। এখানেই তিনি রচনা করেছেন অসংখ্য পুথি ও গীতিকাব্য। তার কাব্যে উঠে এসেছে বাউল-দরবেশ সংস্কৃতির প্রভাব, যেখানে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মমতের এক অনন্য সমন্বয় দেখা যায়।
সত্যপীরের পাঁচালী কাব্যের মধ্যে তার রচিত ‘বড় সত্যপীর ও সন্ধ্যাবতী কন্যার পুথি’ বৃহত্তর। তিনি বাউল-দরবেশ সম্প্রদায়ের শিষ্য। তার কবিতায় হিন্দু ও মুসলমানের সমন্নয়মূলক ভণিতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তার কবিতায় দেখা যায় বিশেষ আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সত্যপীরকে সংগ্রামী ভূমিকায় আসতে হয়েছে।
কৃষ্ণহরি দাস তার “ভনে বাস মেহেরপুর’ কবিতায় লিখেছেন-‘কৃষ্ণহরি দাস ভনে বাস মেহেরপুর/শতেক বন্দেগী মোর সত্যপীরের পায়/তোমার আদেশে গান কৃষ্ণহরি গায়।/তাহের মামুদ গুরু শামস নন্দন/হরনারায়ন দাসে লেখে রচে কৃষ্ণহরি/
শিরে যার সত্যপীর কন্ঠে বাগেশ্বরী/ পঞ্চমীর পুত্র আমি নাম কৃষ্ণহর ‘।
কৃষ্ণহরি দাস রচিত ‘বড় সত্যপীর ও সন্ধ্যাবতী কন্যার পুথি’-তে “অকুমারী সন্ধ্যাবতী” একটি ব্যতিক্রমধর্মী ও তাৎপর্যপূর্ণ নারী চরিত্র হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধে মেহেরপুরে বসবাসকারী এই কবি হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ধারক হিসেবে সত্যপীরকে যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি সন্ধ্যাবতীকেও করেছেন এক প্রতীকী নারী-অভিযাত্রী।
রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী উনিশ শতকের এক প্রখ্যাত কবি, যিনি বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে হাস্যরসাত্মক ও ছন্দনির্ভর কবিতা রচনার জন্য স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি ১১৯৮ বঙ্গাব্দে মেহেরপুর জেলার বুড়িপোতা ইউনিয়নের বাড়ীবাঁকা গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কবির জন্মস্থানের ইতিহাস এবং সাহিত্যিক ধারা-উভয়ই মিশে রয়েছে তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ে।
বাল্যকাল থেকেই কৃষ্ণকান্ত মুখে মুখে কবিতা রচনা করতে পারতেন। এই অসাধারণ প্রাকৃতিক প্রতিভা পরবর্তীতে পূর্ণতা পায় রাজসভায়। দস্যুদের হাতে পৈত্রিক সম্পদ হারিয়ে তিনি জীবিকার সন্ধানে কৃষ্ণনগরে আগমন করেন এবং তদানীন্তন নদিয়া রাজা গিরীশচন্দ্র তাকে মাসিক ত্রিশ টাকা বৃত্তিতে রাজপরিবারের সভাকবির পদে নিযুক্ত করেন।
তিনি সংস্কৃত, বাংলা, হিন্দি ও ফারসী ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। মুখে মুখে পয়ার, ত্রিপদী ও চতুষ্পদী ছন্দে কাব্য রচনায় তার ছিল অসামান্য দক্ষতা। কারও দ্বারা উপস্থাপিত যে-কোনো সমস্যা তিনি কবিতায় রূপ দিতে পারতেন মুহূর্তেই। রাজা গিরীশচন্দ্র তার প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তাকে “রসসাগর” উপাধিতে ভূষিত করেন।
রসসাগরের সাহিত্যজীবনে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল ‘সমস্যা পূরান’, যেখানে তিনি মুখে মুখে সমস্যার সমাধান কবিতার মাধ্যমে করেছেন। তার কাব্যে যেমন ছিল তীক্ষè বুদ্ধি ও রসবোধ, তেমনি ছিল গাঁথুনির নিখুঁত ছন্দ। সমসাময়িক কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে তার ছিল গভীর হৃদ্যতা। একে অপরের প্রশংসায় তারা যে ছন্দ ও কবিতার মাধ্যমে সাড়া দিতেন, তা আজও কাব্যপ্রেমীদের কাছে আকর্ষণীয় দৃষ্টান্ত।
কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী লিখেছেন, ‘বাঙ্গালীর মত কাঙ্গালী কে আর/বাঙ্গালীর জল বায়ু অতি চমৎকার,-/একবার সেবিলেই চক্ষু অন্ধকার।/ম্যালেরিয়া ছারখার করিল এ দেশ/ধনে প্রাণে ক‘রে দিল মানুষের শেষ।’
জীবনের শেষ পর্বে রসসাগর শান্তিপুরে তার কন্যার কাছে থাকতেন এবং সেখানেই ১২৫১ বঙ্গাব্দে তার মৃত্যু হয়। আজও বাংলা সাহিত্যের রসাত্মক ধারায় রসসাগরের নাম উজ্জ্বলভাবে উল্লিখিত হয়, যিনি ছিলেন একাধারে প্রতিভাবান কবি, ভাষাপন্ডিত এবং রাজসভার আনন্দদাতা।
কৃষ্ণহরি দাস ও রসসাগর কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ী-এই দুই কবির সাহিত্য সাধনা কেবল মেহেরপুর নয়, বাংলা সাহিত্যের ভাণ্ডারকেই করেছে সমৃদ্ধ। একজন মধ্যযুগের পুথিকবি হিসেবে ধর্মীয় সম্প্রীতির মূর্ত প্রতীক, অন্যজন আধুনিক যুগের প্রথমাধ্যে হাস্যরসাত্মক ছন্দের শিল্পী। তাদের জীবন ও কর্ম আমাদের সংস্কৃতির প্রাচীন শিকড়কে নতুন করে চিনতে ও গর্বিত হতে শেখায়। আজকের প্রজন্মকে তাদের সাহিত্য পাঠে আগ্রহী করে তোলা, কেবল অতীতকে জানার জন্য নয়-বরং আগামী দিনের সাহিত্য-সংস্কৃতির পথরেখা নির্মাণে সহায়ক হবে। মেহেরপুরের মুখ উজ্জলকারী মধ্যযুগের সাহিত্যের অনতম কবি কৃষ্ণহরি দাস ও নদীয়ার রাজা গিরিশচন্দ্রের সভাকবি কৃষ্ণকান্ত ভাদুড়ীকে আমরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি।