
ভোরের আলো ফুটে ওঠে মেহেরপুরের আকাশে। দূরে মাঠঘেরা গ্রামে কেউ দিন শুরু করে হালচাষে, কেউ হাঁস-মুরগির ডাক শুনে ঘুম ভাঙায়। কিন্তু এই জেলাতেই, একই আলোয় প্রতিদিন কেউ একজন চিরতরে আলোকে বিদায় জানাতে চায়। কেউ গলায় ফাঁস দেয়, কেউ আগাছানাশক বা বিষ খায়। কেউ ঘুমের ওষুধে ঘুমিয়ে যেতে চায় এমনভাবে যেন আর কখনো না জাগে।
২০২৫ সালের মাত্র ছয় মাসে, মেহেরপুরের তিনটি সরকারি হাসপাতালে ৩৬১ জন মানুষ পাকস্থলী পরিষ্কারের জন্য ভর্তি হয়েছেন।
আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে তারা কেউ কীটনাশক খেয়েছেন, কেউ আগাছানাশক বা কীটনাশক ওষুধ। অনেকে বেঁচে গেছেন, অনেকে আর ফেরেননি। যারা ফেরেনি, তারা এখন আর কোনো জরিপের অংশ নয়। আর যারা বেঁচে গেছেন, তারা হয়তো প্রতিদিন একটু একটু করে মরে যাচ্ছেন কিডনি নষ্ট হয়ে, শরীর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে, বা মনটা একেবারে ফুরিয়ে গিয়ে।
এই সংখ্যা শোনার মতো নয়, বোঝার মতো। মেহেরপুর প্রতিদিন পত্রিকায় গত ৫ জুলাই “গড়ে প্রতি ১২ ঘণ্টায় একজন মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করছে” শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। ওই সংবাদ প্রকাশের পর কী কোন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের থেকে। এমন প্রশ্ন করা কী অহেতুক হবে? এটা আমার প্রশ্ন।
যারা এই পথ বেছে নিচ্ছেন তারা কারা? তারা কেউ হয়তো এক মা, সংসারের বোঝা টানতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠেছেন। কেউ স্কুলপড়ুয়া মেয়ে, প্রেমে ছ্যাঁকা খেয়েছে বলে নয়তো মায়ের বকুনিতে মনে করেছে, তার আর কোনো দাম নেই। কেউ একজন দিনমজুর, মাসের শেষে সন্তানকে দুধ কিনে দিতে না পারার যন্ত্রণায় গলায় দড়ি দিয়েছেন। কেউ অভাব মেটাতে এনজিও ঋণে জর্জরিত। তাদের আমরা দেখি না। দেখতে চাইও না। অথচ তাদের কান্না প্রতিদিন আমাদের পাশের ঘরেই শোনা যায়, যদি আমরা কান খুলি।
আইনের চোখে অপরাধ, জীবনের চোখে কান্না
বাংলাদেশের দণ্ডবিধির ৩০৯ ধারা বলে, আত্মহত্যার চেষ্টা করা একটি ফৌজদারি অপরাধ। সাজা এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা জরিমানা। কিন্তু একটা মানুষ যখন নিজেই নিজের জীবন শেষ করতে চায়, তখন কি শাস্তির ভয় দেখালে সে ফিরে আসে?
এই মানুষগুলো চিকিৎসা চায়, কাউকে বুকের ভেতরের যন্ত্রণাটা খুলে বলতে চায়। কিন্তু আমরা তাদের থানায় নিয়ে যাই, চিকিৎসার বদলে জেরা করি।
মেহেরপুর ২৫০ শয্যার জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. সাউদ কবির মালিকের বয়ানে “প্রতিদিন কেউ না কেউ আসে বিষ খেয়ে। কেউ বাঁচে, কেউ না। যারা বাঁচে, তারা কখনো কিডনি হারায়, কখনো হাড়ের ভেতর থেকে ভেঙে যায়।”
এই মানুষগুলো আমাদের চোখের সামনে দিয়ে হেঁটে যায় কেউ স্ট্রেচারে, কেউ হুইলচেয়ারে। তারা ফিরে যায়, কিন্তু আর ফিরতে পারে না জীবনের কাছে।
জেলা তথ্য অফিস বলছে, তারা ৩২টি সচেতনতামূলক সভা, ১৬টি নারী সমাবেশ করেছে। কিন্তু সভা হলে কি বুকের ভেতরের গর্তটা ভরে? বক্তৃতায় কি বিষ কম কাজ করে?
আমাদের সচেতনতার পর্দার পেছনে রয়ে গেছে এক নিঃশব্দ আর্তনাদ। সেই আর্তনাদ চায় একটি স্পর্শ, একটি মনোযোগ, একটি শুনে নেওয়া কান।
বাঁচার অধিকার কেড়ে নেবেন না। এই মানুষগুলো শাস্তির নয়, সহানুভূতির দাবিদার। আমরা যদি চাই, তারা যেন আর আত্মহত্যার পথে না যায়, তবে দরকার: হিংসা পরায়ন রাজনীতি, স্কুলে, কলেজে কাউন্সেলিং, উপজেলা পর্যায়ে মনোরোগ চিকিৎসক, পরিবারে বোঝাপড়ার ভাষা, ভালোবাসার চর্চা। তাহলেই হয়তো সব আত্মহত্যা যে থামানো যাবে না, তা সত্যি। কিন্তু সব আত্মহত্যা যে অপরিহার্য এটা মিথ্যা। মেহেরপুরের এই ছাপ ফেলেছে গোটা বাংলাদেশের বুকজুড়ে। এখন আমাদের দরকার চোখ মেলানো, মন মেলানো। কারণ যারা বাঁচতে চেয়েও বাঁচে না, তাদের ব্যর্থতা নয় তা আমাদের সমাজের ব্যর্থতা।
প্রতিটি বিষপান, প্রতিটি গলায় ফাঁস কোনো সংখ্যার গল্প নয়, তারা একেকটি হাহাকার। এই হাহাকার বন্ধে আমাদের সকলকে উদ্যোগি হতে হবে। তবেই হবে প্রতিটি সুন্দর সকাল।