ইংরেজি শব্দ হিরোইজমের আক্ষরিক অর্থ হলো বীরত্ব, যা সাধারণত ইতিবাচক হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ইদানীং এই শব্দটি আর ইতিবাচক অর্থে যায় না বরং এর পরিবর্তে তা অনেক সময় নেতিবাচক অর্থ প্রকাশ করে। এই যে অল্প বয়সিদের হাতে মোটরসাইকেল উঠছে, দুর্ঘটনা ঘটছে এর পেছনেও আছে এই হিরোইজম প্রবণতা।
আমাদের দেশে উঠতি বয়সি কিশোরদের মাথায় চেপে বসছে হিরোইজমের ভূত। এরা জানেই না প্রকৃত বীরত্ব আসলে কী বা কোন কাজে তা অর্জন করা যায়। রাস্তায় তীব্র বেগে মোটরসাইকেল চালানোতে কোনো হিরোইজম থাকে না বরং নিরাপদে এবং গতি মেনে মোটরসাইকেল বা অন্য যান চালানোতেই প্রকৃত হিরোইজম থাকে। রাস্তায় উচ্চ গতিতে রেসিং করে কোনো হিরোগিরি ফলানো যায় না। বরং ধীরগতিতে বাইক চালিয়ে সুস্থভাবে ঘরে ফেরাকে হিরোইজম বলে।
এই হিরোইজমের অংশীদার কিন্তু অভিভাবকরাও। তা সে ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে আমি কেন অভিভাবকদের দিকে আঙ্গুল উঠাচ্ছি? অভিভাবকরা সন্তানের আবদার পূরণ করতে গিয়ে যেকোনো ভাবেই মোটরসাইকেল কিনে দিচ্ছেন। শিশু-কিশোরদের হাতে ব্যবহৃত হওয়া মোটরসাইকেল যে প্রয়োজনীয় নয় সে কথা জোর দিয়েই বলা যায় বটে। সন্তানরাও এক ধরনের ব্ল্যাকমেইল করছেন অভিভাবকদের। বন্ধুর আছে তাই আমাকেও কিনে দিতে হবে। সে বাবার সামর্থ্য থাক আর না থাক দিতেই হবে। অনেক কিশোর আবার অভিমান করে, না খেয়ে থেকে এমনকি আত্মহত্যার মতো ঘটনার ভয় দেখিয়েও অভিভাবকের কাছ থেকে এসব আদায় করছে। আবার একশ্রেণির অভিভাবক আছেন যারা মোটরসাইকেলের প্রতি সন্তানের ঝোঁক দেখে জেএসসি অথবা এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেলে মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার আশ্বাসও দেন। আবার কিছু অভিভাবক টাকার গরমে শো অফ করতে কিনে দিচ্ছেন ‘ভয়ঙ্কর মৃত্যুফাঁদ মোটরসাইকেল’।
প্রাইভেট পড়া থেকে শুরু করে বন্ধুরা মিলে একসঙ্গে রেসিং সবকিছুই চলে মোটরসাইকেলে। স্কুল কলেজের সামনে পিছনের কিংবা সামনের চাকা উঠিয়ে স্ট্যান নিয়ে মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। এমন কি মেয়েদের টিজ করাও চলে মোটরসাইকেলে। স্কুল কলেজের সামনে মোটরসাইকেল দিয়ে বিকট শব্দ করা। মোটরযান আইন ভেঙ্গে মোটরসাইকেলের অতিরিক্ত একটি সাইলেন্সার পাইপ ( এডজাস্ট পাইপ) লাগিয়ে বিকট শব্দ করে জানান দেয় আমি আসছি! অলিগলিতে এসব মোটরসাইকেল বেপরোয়া গতিতে চালাতে দেখা যায়। উঠতি বয়সী বাইকারদের বাইক চালনার স্টাইল দেখে অনেক সময় নিজেদেরই ভয় করে। জীবন বাঁচাতে নিজেদেরই সাইড দিতে হয়। অথচ এই গতিতে চালানোর জন্য উপযুক্ত রাস্তা এসব নয়। দ্রুতগতির সঙ্গে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার পরিমাণ বাড়ছে। যেমন- অনেক সময় সামনের চাকা উঁচু করে মোটরসাইকেল চালাতে দেখা যায়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নরত কিশোররা তিন-চারজন করে বন্ধু নিয়ে মোটরসাইকেল চালাচ্ছে সর্বোচ্চ গতিতে। তারা উচ্চ শব্দ করে একাধিক মোটরসাইকেল রেসিং এ মেতে উঠছে। আবার কেউ কেউ মোটরসাইকেল অতিরিক্ত গতিতে চালিয়ে মোবাইলে ভিডিও ধারণ করছে টিকটকের জন্য। এই কাজগুলোর পেছনেই কিন্তু কাজ করছে হিরোইজম।
এছাড়া রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের প্রভাবে মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়া গতিতে ছুটছে কিশোর-যুবকরা। তারা মোটরসাইকেলে মহড়া দিচ্ছে হেলমেট ছাড়াই। বর্তমানে কিশোর ও যুবকদের কাছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল বেশ লোভনীয়। উঠতি বয়সী এসব শিশু, কিশোর ও যুবকরাই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে বেশি। বাইকে চড়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছে এসব কিশোর, তরুণ ও যুবক। তাদের মোটরসাইকেলের গতি থাকে সর্বোচ্চ। গতি দেখে ভয় পাচ্ছেন পথচারী ও অন্য যানবাহন চালকরাও।
মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতি সড়কে বাড়ছে দুর্ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় বেশিরভাগই প্রাণ হারাচ্ছে উঠতি বয়সের ছেলেরা। অনেক ক্ষেত্রে আবদার পূরণে শখের বাহন কেড়ে নিচ্ছে আদরের সন্তানের প্রাণ।
বাইক চালকদের ৫৮ শতাংশেরই বয়স ১৪-১৮ বছরের মধ্যে। শখ পূরণে অনেক অভিভাবকই কম বয়সী সন্তানদের হাতে আধুনিক মডেলের উচ্চগতির মোটরসাইকেল তুলে দিচ্ছেন। এই কিশোরদের অধিকাংশই কোনো নিয়ম মানে না। দেশে নিবন্ধিত মোটরযানের প্রায় ৭১ শতাংশই মোটরসাইকেল। এই মোটরসাইকেল চলে গেছে দুই ধরনের লোকের কাছে। যাদের কেউ শখ করে মোটরসাইকেল ব্যবহার করেন, কেউ বাধ্য হয়ে। আর এদের অনেকেই হচ্ছেন অদক্ষ চালক। একটি মানসম্মত হেলমেট বাইক চালকের মৃত্যুঝুঁকি ৪৮ শতাংশ কমিয়ে আনতে পারে। কিন্তু বাইক চালকদের অধিকাংশের হেলমেট নিরাপদ না। তারা হেলমেটের নামে যা মাথায় দেয়, তাকে বড় জোর ‘প্লাস্টিকের ক্যাপ’ বলা যায়।
দেশে গত এপ্রিলে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল ও থ্রি-হুইলারে সবচেয়ে বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। এপ্রিলে ৫৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৫৮৮ জন নিহত এবং ১ হাজার ১২৪ জন আহত হয়েছেন।
সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে নারী ৮৬ জন ও শিশু ৭৮ জন। এ ছাড়া নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় এবং থ্রি-হুইলার দুর্ঘটনায় ২০ দশমিক ২৩ শতাংশ মানুষের মৃত্যু হয়।
মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার প্রধান কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে বেপরোয়া চালনা, মাত্রাতিরিক্ত গতি, আইন না মানা এবং চালকদের সঠিক প্রশিক্ষণ না থাকা।একটু পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, মোটরসাইকেল চালকরা ঘনঘন লেন পরিবর্তন করেন। লেন পরিবর্তনের ফলে অপরদিক থেকে আসা পরিবহনের ওপর উঠিয়ে দেন। অর্থাৎ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার প্রধান কারণ চালকদের বেপরোয়াপনা। এ কারণে মোটরসাইকেলচালকদের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি তাদের ট্রাফিক আইন সম্পর্কে জানাতে হবে। সবচেয়ে যা জরুরি তা হলো, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মনিটরিং। চালক বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালালেই তাকে থামিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর একটি বড় কারণ হেলমেট না থাকা কিংবা নিম্নমানের হেলমেট ব্যবহার করা। তাই শুধু শহরেই নয়, গ্রামাঞ্চলেও চালক ও আরোহীর ভালো মানের হেলমেট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।
মোটরসাইকেল চালানোর জন্য সড়কে আলাদা কোনো লেন নেই। ফলে চালককে বিশৃঙ্খলভাবে মোটরসাইকেল চালাতে দেখা যায়। মোটরসাইকেলের জন্য আলাদা লেন করা জরুরি হয়ে পড়েছে। বেপরোয়া গতিতে মোটরসাইকেল চালানো বন্ধ করতে পারলে দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসবে তাতে সন্দেহ নেই। তাই মোটরসাইকেল চালকদের মোটিভেশনেরও দরকার আছে। আর তা হতে পরে পরিবারের ভেতরেই। পরিবারের অন্য সদস্যরা যদি মোটরসাইকেল চালক সদস্যকে সাবধানে চালানোর দীক্ষা দিতে পারেন, তাহলে তা দুর্ঘটনা রোধে বড় সহায়ক হবে বলে মনে করি।