ভুয়া সনদে নিয়োগ নেওয়ায় দুদকের মামলায় মেহেরপুর সদর উপজেলার বর্শিবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী লাইব্রেরিয়ান আঁখি তারার জামিন না মঞ্জুর করে তাকে কারাগাওে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গতকাল বুধবার মেহেরপুরের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল আদালতের বিচারক জেলা ও দায়রা জজ এস এম নাসিম রেজা এ আদেশ দেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি মামলায় গত ২৫ মে মেহেরপুর জেলা জজ আদালত থেকে বর্শিবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ, সাবেক সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা বিনয় কুমার চাকী, ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি গোলাম মোস্তফা শান্তি এবং বিদ্যালয়ে কর্মরত সহকারী লাইব্রেরিয়ান আখিতারা খাতুনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়না জারি করেন একই আদালত। মামলার অন্য আসামিরা এর আগে আদালত থেকে জামিন পেয়েছেন বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন, জেলা সমন্বিত কার্যালয় কুষ্টিয়ার উপসহকারী পরিচালক মাইদুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। মামলা নম্বর ০৩/২০২৪, তারিখ ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ধারা : দণ্ডবিধির ৪০৯/৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১/১০৯ ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ১৯৪৭ এর ৫(২) ধারায়।
২৫ মে ২০২৫ তারিখে জজ আদালত মেহেরপুর কর্তৃক গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হলেও এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত একজন আসামিও গ্রেফতার হয়নি।
বাদী তার এজাহারে উল্লেখ করেন, বর্শিবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী লাইব্রেরিয়ান আখিতারা খাতুন ভুয়া সার্টিফিকেট খাঁটি হিসেবে উপস্থাপন করে চাকুরি গ্রহণপূর্বক সরকারি ৮ লাখ৮২ হাজার ১২৭ টাকা আত্মসাতের অপরাধ করেছেন।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, আসামি আখিতারা খাতুন ২৮/১১/২০১৯ খ্রিস্টাব্দ তারিখে সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে বর্শিবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে যোগদানের জন্য ‘ডিপ্লোমা ইন লাইব্রেরি সায়েন্স’ ডিগ্রির যোগ্যতা থাকা বাঞ্ছনীয় ছিল। উক্ত বিদ্যালয়ে চাকরিতে যোগদানকালীন সময়ে তিনি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, ঢাকা হতে ইস্যুকৃত মর্মে দেখিয়ে ‘ডিপ্লোমা ইন লাইব্রেরি সায়েন্স’ পাশের একটি সনদ উপস্থাপন এবং দাখিল করেন।কিন্তু এশিয়ান ইউনিভার্সিটি, ঢাকা এর স্মারক নম্বর এইউবি/পরীক্ষা/২০২২/৪৭২, তারিখ ৮/১২/২০২২ খ্রী. মূলে সনদ যাচাই প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, আখিতারা খাতুন এশিয়ান ইউনিভার্সিটির যে সনদ ব্যবহার করেছেন সেটি জাল/ভুয়া। উক্ত ‘ডিপ্লোমা ইন লাইব্রেরি সায়েন্স’ ডিগ্রি না থাকা সত্ত্বেও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি কর্তৃক ইস্যুকৃত ভুয়া সার্টিফিকেট দাখিল করে সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে যোগদান করেছেন।
ব্যাংক হিসাব বিবরণী অনুযায়ী দেখা যায়, তিনি ডিসেম্বর ২০১৯ থেকে মে ২০২৪ পর্যন্ত সময়ে বর্শিবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় হতে সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে চাকরির বেতনভাতা বাবদ মোট ৮ লাখ ৮২ হাজার ১২৭ টাকা উত্তোলন করেছেন। যা ‘ডিপ্লোমা ইন লাইব্রেরি সায়েন্স’ এর ভুয়া সার্টিফিকেট খাঁটি হিসেবে উপস্থাপন করে বর্শিবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে চাকুরি গ্রহণপূর্বক সরকারি ৮ লাখ ৮২ হাজার ১২৭ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।
এছাড়া বর্শিবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি গোলাম মোস্তফা, প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ এবং মেহেরপুর সদর উপজেলা সাবেক মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিনয় কুমার চাকী আসামি আখিতারা খাতুনের সাথে পারস্পরিক যোগসাজশে তাকে উক্ত ভুয়া সার্টিফিকেট ব্যবহারের মাধ্যমে বিদ্যালয়ে চাকুরিতে নিয়োগ এবং সরকারি ৮ লাখ ৮২ হাজার ১২৭ টাকা আত্মসাতে সহায়তা করেছেন। উক্ত ঘটনার সাথে অন্য কারো সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে এজাহারে উল্লেখ আছে।
এ বিষয়ে দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদন ও অন্যান্য রেকর্ডপত্রে আরো অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
আখিতারা খাতুনের নিয়োগ বোর্ডে পাঁচ জন সদস্য ছিলেন বিদ্যালয় ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি গোলাম মোস্তফা শান্তি, ডিজি প্রতিনিধি কাজী মোঃ আনিসুজ্জামান, সাবেক উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার, (মন্ত্রণালয় প্রতিনিধি) বিনয় কুমার চাকী, অভিভাবক প্রতিনিধি মোঃ আনারুল ইসলাম ও বর্শিবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ আবুল কালাম আজাদ।
নিয়োগ বোর্ড তিনজন আবেদনকারীর আবেদন যাচাই-বাছাই করে ২০/১১/২০১৯ খ্রি. তারিখে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণ করে। রেজুলেশন বহির সত্যয়িত ছায়ালিপি থেকে দেখা যায়, আখিতারা খাতুন নিয়োগ পরীক্ষায় ৪৩ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করেন এবং নিয়োগ বোর্ড তাকে সহকারী গ্রন্থাকারীক পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে। পরে ২৮/১১/২০১৯ তারিখে তিনি বিদ্যালয়ে যোগদান করেন।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, কাজী আনিসুজ্জামান প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন না, অথচ ডিজি প্রতিনিধি হিসেবে তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে অভিভাবক সদস্য আনারুল ইসলাম লিখতে পড়তে জানতেন না। সেই সুযোগে প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ তাকে ভুল বুঝিয়ে বিভিন্ন সময়ে নিয়োগ সংক্রান্ত ডকুমেন্টে স্বাক্ষর করিয়ে নেন। আনারুল ইসলাম তদন্তকালে জানান, আখিতারা খাতুনের ভুয়া সনদের বিষয়টি তিনি জানতেন না।
প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ ইচ্ছাকৃতভাবে আখিতারা খাতুনের নিয়োগকালীন সময়ের আবেদনপত্রসহ অন্যান্য কাগজপত্র বিনষ্ট করেছেন বলে অনুসন্ধানে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তদন্ত কর্মকর্তার কাছে তিনি লিখিতভাবে জানিয়েছেন, নিয়োগকালীন সময়ের দাখিলকৃত মূল আবেদনপত্র, সনদ, পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তি এবং রেজুলেশনবহির মূল কপি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
মামলার সাক্ষীরা হলেন, দুদকের উপসহকারী পরিচালক সৈয়দ মাইদুল ইসলাম, সহকারী পরিচালক নীলকমল পাল, এশিয়ান ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মো. তারেক কুদ্দস, অভিভাবক সদস্য মোঃ আনারুল ইসলাম, রূপালী ব্যাংকের শাখা প্রধান মো. হামিদুল ইসলাম, মো. মশিউর রহমান, কাজী মো. আনিসুজ্জামান, সহকারী প্রধান শিক্ষক দিলারা পারভীন, মেহেরপুর সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল লতিফ, দুদকের উপসহকারী পরিচালক, মো. আবু তালহা, সহকারী শিক্ষক (ধর্ম) মো. শরিফুল ইসলাম ও দুদকের উপসহকারী পরিচালক সৈয়দ মাইদুল ইসলাম।
উল্লেখ্য, প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদের বিরুদ্ধে বর্শিবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে মেহেরপুর প্রতিদিন পত্রিকায় একাধিক সিরিজ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ তো নেয়নি, বরং প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদের সাথে তৎকালীন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বিনয় কুমার চাকী সীমাহীন দুর্নীতির সাথে যুক্ত ছিলেন। শুধুমাত্র বর্শিবাড়িয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ই নয়, মেহেরপুরের আরও একাধিক স্কুলের দুর্নীতির সাথেও বিনয় কুমার চাকীর প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, যা অনুসন্ধান করলেই বেরিয়ে আসবে।