“পানির অপর নাম জীবন” কিন্তু সেই পানিই আজ জীবনকে বিষাক্ত ও বিপন্ন করে তুলেছে। জলবায়ু পরিবর্তন, আধুনিক কৃষিতে বিষাক্ত রাসায়নিক ব্যবহার ও অপরিকল্পিত উন্নয়নের ফলে ভূগর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা ও দর্শনা এলাকায় এর প্রভাব মারাত্মক।
দামুড়হুদা উপজেলার হাউলী ইউনিয়নের বড় দুধপাতিলা গ্রামে ২৫৮টি টিউবওয়েলে আর্সেনিক পাওয়া গেছে। এ গ্রামে প্রায় ৪০০ জন নারী-পুরুষ আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। গত ২৫ বছরে এ গ্রামে আর্সেনিকজনিত রোগে মারা গেছেন ১৪ জন। অন্যদিকে, দর্শনার ডিহিকৃষ্ণপুর গ্রামের গাবতলা পাড়ায় প্রায় ১৮৫ জন আক্রান্ত এবং ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৮ জনে।
আক্রান্তদের মধ্যে অনেকেই আছেন দীর্ঘমেয়াদি শারীরিক যন্ত্রণায়। কারও কারও হাত-পায়ে গুটি, বাদামি দাগ, চামড়া পুরু হয়ে যাওয়া, আঙুল বেঁকে যাওয়া এবং অসাড়তা দেখা যাচ্ছে। কারও পেটের সমস্যা, খাদ্য হজমে ব্যাঘাত, এমনকি ক্যান্সার পর্যন্ত দেখা দিচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানায়, আর্সেনিক আক্রান্তদের মধ্যে অন্তত ২৫০ জন স্বাস্থ্য কার্ডধারী।
২০০২ সালে জাপানি উন্নয়ন সংস্থা জাইকার সহায়তায় বড় দুধপাতিলা গ্রামে একটি আর্সেনিকমুক্ত ওয়াটার ট্যাংক স্থাপন করা হলেও এখন তা অকেজো হয়ে পড়েছে। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থায়নে ও এনজিও ফোরাম ফর পাবলিক হেলথের বাস্তবায়নে বড় দুধপাতিলা ও হরিরামপুর গ্রামে ৪০ লাখ ৪২ হাজার ৭০০ টাকা ব্যয়ে দুটি পাইপ লাইন ওয়াটার সাপ্লাই সিস্টেম স্থাপন করা হয়। বর্তমানে ১৬৮টি পরিবার সেখানে কমমূল্যে বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে। এগুলোর একটি পরিচালনা করছেন বড় দুধপাতিলা গ্রামের বকুল হোসেন।
তবে এসব ব্যবস্থা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ডিহিকৃষ্ণপুর গাবতলা পাড়ার বাসিন্দারা প্রতিদিন ৩-৪ বার অন্যের বাড়ি থেকে পানি সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছেন। সেখানকার যুবক সবুজ জানায়, তাদের গ্রামে ১৯৯৯ সালেই প্রথম আর্সেনিক ধরা পড়ে। এখনো অনেক টিউবওয়েলের পানি আর্সেনিকযুক্ত, কিন্তু বিকল্প না থাকায় বাধ্য হয়ে সেটাই ব্যবহার করতে হচ্ছে।
জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, দামুড়হুদা উপজেলায় ১১,০২২টি শ্যালো টিউবওয়েলের মধ্যে ৮,৬২৩টি পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ১,৮৬৪টি টিউবওয়েলে আর্সেনিক রয়েছে। দর্শনা পৌরসভায় পরীক্ষা করা ৪,৭৭৩টি টিউবওয়েলের মধ্যে ১,০৬৭টিতে আর্সেনিক ধরা পড়ে।
ভুক্তভোগীরা জানান, আর্সেনিকজনিত রোগের স্থায়ী চিকিৎসা নেই। এ অবস্থায় জরুরি ভিত্তিতে নতুন একটি আর্সেনিকমুক্ত ডিপ টিউবওয়েল বসানোর দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী।
চুয়াডাঙ্গা সিভিল সার্জন ডা. হাদী জিয়াউদ্দিন বলেন, “প্রথমে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, এরপর আক্রান্তদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে। আমি খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।”
এদিকে, জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী আমিনুল ইসলামের সাথে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।